১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১২:২২

বিদেশী ঋণ আর কত?

-ইবনে নূরুল হুদা

আমাদের দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই ঋণ ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি) ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দেশের মোট বিদেশী ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার। বাকি ২১ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত।

গত মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশী ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের বিদেশী ঋণ ৪ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ সময়ে সরকারের বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। সরকারের বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ৩৩ কোটি ডলার কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের স্থিতি ২০ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। যা এখন জাতীয় অর্থনীতির জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, নানা কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশী ঋণের স্থিতি কিছুটা কম দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে এ ঋণের প্রকৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সরকারের বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বিদেশী উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ নেয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও ছিল খুবই কম। কিন্তু এরপর থেকে সরকারের বিদেশী ঋণ দ্রুত গতিতে বেড়েছে। একই সঙ্গে বিদেশী ঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতেরও। সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের স্থিতি গত ডিসেম্বর শেষে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। সে হিসাবে গত ১৩ বছরে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৩৯৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। ঋণের এ অনুপাতকে অর্থনীতির জন্য মোটেই উদ্বেগজনক নয় বলে মনে করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ‘বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও দেশের জিডিপির আকারের তুলনায় এটি খুব বেশি নয়। এখনো অনেক বিদেশী ঋণ নেয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। বিশ্ববাজারে সুদহার বাড়ায় দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ কমে গেছে। এটি না হলে বিদেশী ঋণের স্থিতি অনেক আগেই ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত।’ কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যকে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত মনে করছেন না অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বরং বিষয়কে রীতিমত ঘোড়ারোগ বলেই মনে করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষেও বিদেশী উৎস থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। বাকি ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছিল স্বল্পমেয়াদি। ওই সময় বিদেশী ঋণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর থেকে বিদেশী ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।
বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশী ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আর গত বছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কন্দ্রে নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি এখন ১১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ রয়েছে ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় ক্রমাগত বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, ওই সময় রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর থেকেই রিজার্ভের ক্ষয় শুরু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশী ঋণ-জিডিপির অনুপাত হিসাব করাই অর্থহীন; কারণ এখানে কর-জিডিপির অনুপাত খুবই কম। তারা বলছেন, ‘বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো সরকার নিজস্ব আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম নয়। এজন্য এখানে জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত হিসাব করে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে ঋণের অনুপাত তুলনা করতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। কোনো দেশের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২০০-২৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি। সে হিসেবে সরকারের ঋণ অনেক আগেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর থেকে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকবে। ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে।’ আর সার্বিক পরিস্থিতি সেদিকেই মোড় নিচ্ছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশী ঋণের অর্থছাড় ১০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছিল। কিন্তু গত দুই অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে বিদেশী ঋণের অর্থছাড়ে ব্যর্থ হচ্ছে সংস্থাগুলো। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থছাড় করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বাকি মাসে সব মিলিয়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থছাড় করাও এখন শঙ্কার বিষয়।

এরমধ্যে শুধু সুদ পরিশোধই বেড়েছে ৪২ শতাংশ। আর এ অর্থবছর যত ঋণ এসেছে তার প্রায় ৪৪ শতাংশের বেশি গিয়েছে আগের ঋণ পরিশোধে। গত মার্চে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে ৭০২ কোটি ডলারের অর্থছাড় হয়েছে। এরমধ্যে ৬৬১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার ঋণ আর বাকি ৪০ কোটি ৫১ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছর বিদেশী ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ে ঋণের অর্থছাড় হয়েছিল ৬৯৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের। বিদায়ী অর্থছাড় যা হয়েছে তার ৪৩ দশমিক ৭০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয়েছে আগের নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধে। এ বছর ঋণ পরিশোধ বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সাথে সাথে ঋণ পরিশোধের চাপও পড়েছে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। গেল অর্থ বছরে বিদেশী ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারের, গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ২৪৬ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। মূলত, বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের এ সময়ে সবচেয়ে বেশি চাপে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে। বছরের ব্যবধানে শুধু সুদের ব্যয়ই বেড়েছে ৪২ শতাংশের বেশি। তবে বাংলাদেশের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ বছর শুধু বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতিই এসেছে ৭৯২ কোটি ৭৬ লাখ বা প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৫৯৭ কোটি ৪৬ লাখ বা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে বিভিন্ন শর্ত মানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হচ্ছে। এসব শর্ত অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে তুলছে। সর্বশেষ একদিনে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ডলারের এই দর বৃদ্ধিতে চাপ তৈরি হবে বিদেশি ঋণ পরিশোধে। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসায় আরেক চাপ তৈরি হয়েছে।

এদিকে বিদেশী ঋণের চাপ যখন অনেকটাই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনও থেমে নেই সরকারের ঋণ করার প্রবণতা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিগত ছয় মাসের হিসাবে সরকারি বেসরকারি মিলে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ২৭৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে বিদেশী ঋণ ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার, গত মার্চে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৯৩০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যে হারে বিদেশী ঋণ বাড়ছে তা থামানো না গেলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে দায় পরিশোধের চ্যালেঞ্জ। ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এতে জনগণের ঘাড়ে ঋণের বোঝা বাড়বে। আর এসব ঋণ পরিশোধের জন্য জনগণের ঘাড়ে চাপবে করের বোঝা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশী ঋণ যে পর্যায়ে আছে তাতে নতুন করে ঋণ বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ, বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়ার অর্থই ভবিষ্যতে চাপ বেড়ে যাওয়া। এমনিতেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, এর ওপর বিদেশী ঋণ বাড়লে সুদে-আসলে তা পরিশোধ করতে হবে। আর এ দায় পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে। ফলে অর্থনীতিতে নানাবিধ সঙ্কট দেখা দেবে।

বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নেয়া নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। প্রথমত, যাকে বা যে শিল্প গ্রুপকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হবে, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে সেটা আগে যাচাই করা দরকার। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হবে, সেটা বৈদেশিক মুদ্রা আয় বর্ধক খাত কি না তা আগে দেখতে হবে। যদি ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা না থাকে, বা যে উদ্দেশ্যে ঋণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে সেটা থেকে যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হয় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের সাথে বিনিময় মূল্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ, কয়েক বছর আগেও প্রতি ডলার ছিল ৭৭ টাকা। এখন প্রতি ডলার ১১৮ টাকা। এতে আপাতত সুদ কম হলেও পরিশোধের সময় এসে প্রকৃত সুদ বেড়ে যাচ্ছে।

কারণ, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত দিতে হবে। যিনি ঋণ ফেরতে দেবেন, তাকে স্থানীয় মুদ্রায় ডলার কিনেই ফেরত দিতে হবে। ফলে প্রকৃত সুদ অনেক বেড়ে যায়। তৃতীয় ঝুঁকি হলো বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে প্রকৃত পণ্য না কিনে অথবা কম দামের পণ্য এনে বেশি দাম দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে থাকে। এরকম কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা উদঘাটন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। আবার অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় যে উদ্দেশ্যে ঋণ আনে ওই কাজে আর ব্যবহার করেন না। কেউবা স্থানীয় ঋণ পরিশোধ করেন বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বেসরকারি খাতে ঋণ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এ কারণে গবর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। ওই কমিটিতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঋণ অনুমোদন দিতে হয়। তিনি মনে করেন, এসব ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় বেড়ে যাবে। চাপ বেড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ছয় মাসে সরকারি ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে সরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ছিল সাত হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। মার্চে তা বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ৯০০ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে সরকারের বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৭৪ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতে মার্চ শেষে বিদেশী ঋণ হয়েছে দুই হাজার ৩০ কোটি ডলার, যা ছয় মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে ছিল দুই হাজার ১২৮ কোটি ডলার। তবে, বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদির তুলনায় দীর্ঘমেয়াদে বেশি বাড়ছে। সেপ্টেম্বরে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল ৮৮৫ কোটি ডলার, মার্চে এসে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯২৬ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, আমাদের বৈদেশিক ঋণ ইতোমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই ঋণপ্রবাহ ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। সরকার বৈদেশিক ঋণ নিতে কোনভাবেই অগ্রপশ্চাৎ ভাবছে না বরং অপরিণামদর্শীর মতই প্রতিনিয়তই বাড়াচ্ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। ফলে প্রত্যক্ষ চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর। আর বৈদেশিক ঋণপ্রবণতা এভাবে চলমান থাকলে আগামী দিনে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে, ঋণ করে বহিরাভরণ চাকচিক্যময় করার চেয়ে ঋণহীন মালিন্যই শ্রেয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই কল্যাণ।

https://www.dailysangram.info/post/561115