১০ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১:৫০

সিলেটে এক মাস ধরে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি

সিলেটের মানুষের পানিবন্দি জীবনের ইতি সহসাই হচ্ছে না। বন্যা স্থায়ী রূপ নেয়ার কারণে দুর্দশা কাটছে না অন্তত সাড়ে ৫ লাখ মানুষের। জীবন থমকে গেছে তাদের। প্রশাসন থেকে ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার ও ১০ কেজি চাল পেয়েছেন। এতেও তাদের চলছে না। এবার বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা নেই বললেই চলে। ফলে অনাহারে, অর্ধাহারে কাটাতে হচ্ছে জীবন। এই অবস্থায় বন্যায় ভেঙেছে ঘরবাড়ি। তলিয়ে গেছে মাঠে ফসল। গবাদিপশুও বিক্রি করতে হয়েছে পানির দরে।

সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষ। সিলেটের কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকা ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ। বর্তমানে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি কিংবা নিচে চলে এসেছে। কিন্তু কুশিয়ারার পানি কমছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, দুটি কারণে কুশিয়ারা নদীর অববাহিকার পানি কমছে না। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে- ভারতের বরাক থেকে এখনো ঢল নামছে। আর সিলেট অঞ্চলের পানির বেসিনও সংকুচিত হয়েছে। সুনামগঞ্জসহ ভাটি অঞ্চল পানিতে টুইটুম্বুর থাকার কারণে পানি কমছে না।

তিনদিনে যে পানি কমে এক রাতের বৃষ্টিতেই সে পরিমাণ পানি বেড়ে যায়। কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসিদ, শ্যাওলা ও ফেঞ্চুগঞ্জে বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বিকালে ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকা দিয়ে সিলেটের উজানের পানি নামার পাশাপাশি মৌলভীবাজারের পানি নামে। এ কারণে সিলেট জেলার মধ্যে বন্যার তাণ্ডব চলছে ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জে। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জের মানুষও একইভাবে একমাস ধরে বন্যাকবলিত হয়ে আছেন। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, সিলেটের ৩টি পৌরসভা ও ৯৮টি ইউনিয়নের সাড়ে ৫ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এর মধ্যে ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এদিকে প্রশাসনের তরফ থেকে যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে এই পরিসংখ্যান কুশিয়ারা তীরবর্তী ৬ উপজেলার। অন্য ৭ উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমেছে। আশ্রয়কেন্দ্রেও তেমন মানুষ নেই। কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন; এক মাসের অধিক সময় ধরে তাদের এলাকার প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঈদও করেছেন পানির মধ্যে। মাঝখানে ৩-৪দিন স্বস্তি ছিল। কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেনও। কিন্তু ফের বন্যা আসার কারণে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। বিশেষ করে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের ২ শতাধিক বিদ্যালয় এখনো পানির নিচে। এর মধ্যে দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ওসমানীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম আহমদ ভিপি মানবজমিনকে জানিয়েছেন; পানি না কমার কারণে ৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ২ হাজার ৮০ জন বানভাসি মানুষ বাড়ি ফিরতে পারছে না। অনেক জায়গার মানুষ একমাস ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। তাদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আর যারা বাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তাদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসীরা এসে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনহার মিয়া জানিয়েছেন, যেভাবে রাতারাতি পানি এসেছিল সেভাবে কমছে না। তৃতীয়দফা যে ঢল নেমেছিল সেই ঢলে বহু স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি কমার কারণে মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ বেড়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে, বৃষ্টি কমে গেলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ। তিনি গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেট জেলায় সুরমা, কুশিয়ারাসহ অনেক সীমান্ত নদীর ২৫ কিলোমিটার এলাকার বাঁধ ভেঙে গেছে। কোথাও কোথাও পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকছে। এখনো কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার নদীর বাঁধগুলোর পানি নিচে রয়েছে। তৃতীয় দফা অর্থাৎ ১লা জুলাই থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে বেশিসংখ্যক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।

পানিবন্দি অবস্থায় পরীক্ষা: সিলেটের এবারের এইচএসসি পরীক্ষা পানিবন্দি অবস্থায় দিচ্ছেন পরীক্ষার্থীরা। নগরের মধ্যেই দক্ষিণ সুরমা কলেজের অবস্থান। গতকাল পরীক্ষার শেষ হওয়ার সময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল; উঠোন পর্যন্ত পানি রয়েছে। রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি। এই অবস্থায় যাতায়াতের জন্য বালির বস্তা ফেলে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। আর ওই বালির বস্তার উপর দিয়ে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢুকেছিলেন, পরীক্ষা শেষে বের হচ্ছিলেন। এ দৃশ্য কেবল দক্ষিণ সুরমা কলেজের নয়। ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জের অধিকাংশের কেন্দ্রের অবস্থাও ছিল এই রকম। পানিবন্দি অবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীরা নৌকাযোগে এসে পরীক্ষায় অংশ নেন। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, কলেজের প্রবেশ পথে পানি থাকলেও পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে রাস্তায় বালুর বস্তা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি শ্রেণিকক্ষে পানি রয়েছে। তবে সেগুলোতে পরীক্ষার হল রাখা হয়নি। এ ছাড়া বালাগঞ্জ ডিএন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থাকলেও সেখানে পানি থাকায় এ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা বালাগঞ্জ সরকারি কলেজে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়াতে কেন্দ্রের আশপাশে কোনো পানি নেই। এটা বিবেচনা করেই মঙ্গলবার থেকে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।

https://mzamin.com/news.php?news=117957