৯ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার, ১:১৩

কোটা সংকটের যৌক্তিক সমাধান অপরিহার্য

-ড. মো. নূরুল আমিন

দেশের বিশ্ব বিদ্যালয়সমূহের ছাত্র-শিক্ষকরা এখন আন্দোলনে ব্যাপৃত রয়েছেন। শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থার পরিবর্তে সরকারের প্রবর্তিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রত্যয় স্কীমে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে। ছাত্ররা আন্দোলন করছে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের বিরুদ্ধে। শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন না, পরীক্ষাও নিচ্ছেন না। ছাত্ররা ক্লাসে যাচ্ছেন না। ক্লাসে ধর্মঘট চলছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ হচ্ছে; গত রোববার সড়কে ‘বাংলা ব্লকেড’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই আন্দোলনে রত থাকায় শিক্ষাঙ্গনে এখন শিক্ষা নেই। স্কুলে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শব্দটির পরিবর্তে সরকার এর নাম দিয়েছেন মূল্যায়ন। এই এক অভিনব মূল্যায়ন; এতে কোনও নম্বর নেই। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের দেয়া তথ্যানুযায়ী ছেলেমেয়েরা ৫/৭ জন মিলে বই খুলে, মোবাইল দেখে দেখে ‘গ্রুপওয়ার্ক’ করে। এই পরীক্ষা বা মূল্যায়ন সকাল এগারোটায় শুরু হয়ে বিকেল তিনটায় শেষ হয়। সময় ৫ ঘণ্টা। দেশ বিদেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখেছি, ছাত্র হিসেবে এবং শিক্ষক হিসেবে এমন মূল্যায়ন কখনো দেখিনি। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে অভিভাকরা বলছেন, এতে শিক্ষার্থীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্রুপ ওয়ার্কের নামে তাদের সন্তানদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এখন মূল কথায় আসি।

কোটা প্রথা এবং পেনশন এই দুইটি বিষয় সম্পূর্ণ মীমাংসিত বিষয় (Settled Issue)। মীমাংসিত ইস্যুগুলোকে অমীমাংসিত ইস্যুতে পরিণত করার ফলে দেশব্যাপী এখন আন্দোলন হচ্ছে, অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার বলছেন তারা শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত নন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে সতর্ক। সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রলীগ ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা করার ঘটনাও ঘটিয়েছে।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০১৮ সালে সারা দেশে কোটা বিলোপের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের আন্দোলনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, সারা দুনিয়াকে সাক্ষী রেখে প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, সরকারি চাকরিতে কোন কোটা থাকবে না। তার এই ঘোষণার পর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকও করেছেন। এ ব্যাপারে সরকার কর্তৃক একটি রিভিউ কমিটিও গঠিত হয় এবং তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ঐ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রচলিত কোটা পদ্ধতি বাতিল করেন। ঘটনার এখানেই ইতি ঘটার কথা ছিল। কিন্তু ঘটেনি, অভিযোগ রয়েছে যে, ছাত্রলীগ ও সরকারি দলের আশীর্বাদ নিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ পরিচয় দিয়ে কয়েকজন যুবক সরকারি প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্র্টে একটি মামলা করেন। হাইকোর্ট তথা উচ্চ আদালত কোটা প্রথা বহাল রাখার অনুকূলে রায় প্রদান করেন। আবার সুপ্রীম কোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। এই মামলার শুনানিকালে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে প্রকৃত অবস্থা জানানো উচিত ছিল, বলা দরকার ছিল যে, একটি বৃহৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত রিভিউ বা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কোটা প্রথা সরকার বিলোপ করেছেন এবং এটি সম্পূর্ণভাবে মীমাংসিত একটি বিষয়। সরকার তা করেননি বরং অতিপরিকল্পিতভাবেই সরকার পক্ষ আদালতকে বিভ্রান্ত করেছে বলেই মনে করছে আত্মসচেতন মহল। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে সরকারই বিষয়টি আনসেটেল করে একটি নতুন ইস্যু সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যাতে করে দেশব্যাপী চরম দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার পুঁজি পাচার এবং ভারতের সাথে দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা যায়। আর অবস্থাদৃষ্টে সে কথায় দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই অভিযোগটি গুরুতর এবং তার সত্যতা সম্পর্কে সরকারই ভাল বলতে পারবেন। অবশ্য কোটা বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য সাধারণ মানুষের উপরোক্ত ধারণাকেই দৃঢ় করেছে। এই দেশে একটি কথা প্রচলতি আছে ‘হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না। দেখা যাচ্ছে, যে হাকিম হুকুম দিলেন সেই হাকিম গদিতে বহাল তবিয়তে থাকতেই তার দেয়া হুকুম এখন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা কোথায় বসবাস করছি।

কোটা আর মেধা এক সাথে চলতে পারে না। কোটা মেধা বিকাশের পরিপন্থী। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাংলাদেশে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মহিলা কোটা, তফশীলি উপজাতি কোটা, জেলা কোটা ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সময় এই কোটার হয়তো দরকার ছিল, কিন্তু বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবেশও পাল্টেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আর কোটার দরকার নেই বলেই জাতি মনে করে। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় চুয়ান্ন বছর এবং অবস্থা এতই পাল্টেছে যে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এখন সবকিছুই আমাদের মেধার ভিত্তিতে যাচাই করে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তারা ব্যক্তিস্বার্থে যুদ্ধ করেননি। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা কিছু সুযোগ-সুবিধা তাদের দিচ্ছি বা দেয়ার চেষ্টা করছি। ভালো কথা, ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা কোটার সমর্থন করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মুসলমানদের উপর কাফেরদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে বিজয়ী মুসলমানদের প্রাপ্ত সম্পদ তথা গনিমতের মাল বণ্টনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এটা তাদের বৈধ প্রাপ্য। বাংলাদেশ ভূখণ্ডটি দখলকৃত কোনো ভূখণ্ড নয়, জালিম শাসকদের হটিয়ে দিয়ে স্বাধীন ও মুক্ত করা একটি ভূখণ্ড। গণিমতের প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। এখানেও ক্ষমতাসীনরা জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে।

কোটা মেধার বিকাশ ও মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করে, যুব সমাজের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হোক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা বাস্তবায়ন, আমাদের মনে অবনমিত হয়। কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নিম্নমানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে বিশ্বব্যাংক Government That Works শীর্ষক এক রিপোর্টে তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার অদক্ষতার একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন। রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, তারা Aid Negotiation করতে জানেন না, এমনকি ইংরেজিতে একটি চিঠির মুসাবিদা কিভাবে করতে হয় সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই, দাতা সংস্থাগুলোকেই এই খসড়া তৈরি করে দিতে হয়। এটা ছিল অপমানকর মন্তব্য। এর আরেকটি দিক আছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সত্যিকার অর্থে বিগত বছরসমূহে কখনো কোটার সদ্ব্যবহার হয়নি। কোটা থেকে সুযোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কোটার ছত্রছায়ায় নিয়োগ পেয়েছে অযোগ্য দলীয় ক্যাডাররা। ক্ষমতাসীন দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার সাথে আমার আলাপ হয়। তাদের মতে, যারা মেধাবী তারা বেয়াদব হয়, সরকারি নেতাদের কথা শুনে না। যারা মেধাবী নয় তারা সরকারের অনুগত হয় এবং সরকারকে রক্ষা করে। সরকারের দরকার তাদের যারা চাকরি রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে হলেও সরকারকে রক্ষা করবে। অদ্ভুত যুক্তি।

বর্তমান সরকারের আমলে বিতর্কিত ও প্রচলিত কোটার আড়ালে মেধা তাড়ানোর জন্য তারা আরো কিছু উপকোটার ব্যবস্থা করেছেন, যা হয়তো অনেকেই জানেন না। এখন সরকারি চাকরি পেতে হলে অনেক কিছু দেখা হয়। যেমন চাকরিপ্রার্থী ছাত্রজীবনে কোন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল, তার ভাইবোন, পিতা-মাতা, চাচা, মামা ও নিকটাত্মীয়রা কোন রাজনৈতিক দল করেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল বা আছে কিনা ইত্যাদি। এরা যদি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ অথবা লীগপন্থী কেউ না হয়ে থাকেন তাহলে তাদের কপালে চাকরি জুটবে না। হিন্দু হলেও এমনিক আওয়ামী হিন্দু হতে হবে। ঘধঃরড়হধষ ঝবৎারপব-এর নামে দেশে বর্তমানে যে আওয়ামী সার্ভিস চালু রয়েছে তার একটু খোঁজখবর নিন, তাতে বুঝা যাবে কোটা কত প্রকার ও কী কী।

বাংলাদেশে বেকারত্ব এখন একটি বিরাট সমস্যা। কর্মক্ষম প্রায় সাড়ে দশ কোটি লোকের মধ্যে তিন কোটিই বেকার। এটা পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব। ছদ্মবেশি বেকার তো আছেই। শিক্ষিত বেকারদের দুর্দশা চরমে। লেখাপড়া শিখে, উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না, তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। আমাদের জাতীয় জীবনে শিশুরা অনাগত, বৃদ্ধেরা শতায়ু। যুবকরাই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, এমতাবস্থায় তাদের হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ না করে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের পূর্ব সিদ্ধান্তটি বহাল রাখা বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি। যা মাননীয় আদালতকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করে সরকারের নির্বাহী আদেশেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

পেনশনের বিষয়টি বারান্তে আলোচনা করার আশা রাখি, ইনশাআল্লাহ।

https://www.dailysangram.info/post/560727