৮ জুলাই ২০২৪, সোমবার, ১১:৪৭

পূর্ণিমা ঘিরে আতঙ্কে খুলনার উপকূলবাসী

দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর খুলনার উপকূলীয় কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার বেড়িবাঁধগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করা হলেও চলতি বর্ষা মওসুমে নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। গত ৩-৪ দিনে ভারী বর্ষণের ফলে বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় নির্ঘুম রাত পার করছেন উপকূলীয় উপজেলাগুলোর বাসিন্দারা। আসন্ন পূর্ণিমায় জোয়ারের পানির চাপ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কায় বাঁধ নিয়ে চিন্তিত এলাকাবাসী। আমনের বীজতলা নিয়ে আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা। ভারী বর্ষণে দুর্বল হয়ে যাওয়া বাঁধগুলো প্রবল জোয়ারের চাপ সামলাতে পারবে না এমন আশঙ্কা তাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, খুলনার চার উপকূলীয় উপজেলায় বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী বলছে, এমনিতেই নদ-নদীগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানি ২/১ ফুট উপর দিয়ে বইছে। পূর্ণিমার কারণে এই পানির চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের শিবসা, পশুর, ভদ্রা, কয়রার শাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ নদ, খোলপেটুয়া নদী, পাইকগাছার শিবসা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার শোলমারি ও কাজীবাছা নদীতে পানির চাপ বেড়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধ ছুঁয়েছে পানি।

সূত্র জানায়, খুলনার চারটি উপকূলীয় উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে কয়রা উপজেলা। ২০০৭ সালের প্রলঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছ্বাস, ২০০৯ সালে জলোচ্ছ্বাস আইলা ও এরপর ২০১৩ সালে মহাসেন’র পর পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণিঝড় ফণী, আম্ফান, ইয়াস, মোখা, বুলবুল ও সর্বশেষ রিমাল আঘাত হানে উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটাসহ খুলনা অঞ্চলে। এসব ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপজেলাগুলোর বাঁধগুলো বালুর বাঁধের মতো ভেসে যায়। তলিয়ে যায় হাজার হাজার বিঘা ফসলের জমি, ঘের ও পুকুর। ভেঙে যায় উপকূলের প্রায় সব কাঁচা ঘরবাড়ি। কয়রা উপজেলার ভাঙন কবলিত উত্তর বেদকাশী এলাকার বাসিন্দা আলিমুল ইসলাম, জোহরা বেগম, প্রিতম সানা বলেন, প্রতিবার ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মানুষ। কিন্তু বাঁধগুলো সঠিকভাবে এবং স্থায়ীভাবে মেরামত না করার কারণে সাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ এবং অন্যান্য নদ-নদীগুলোর পানি একটু বাড়লেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।

একই এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, রেমালের পর বাঁধগুলো মেরামত করা হলেও অনেক স্থানে নতুন করে আবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে বাঁধগুলো খুবই দুর্বল হয়ে গেছে। জোয়ারের পানির চাপ একটু বাড়লেই ভেঙে যেতে পারে বাঁধ।

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, নদ-নদীগুলোতে বর্তমানে জোয়ারের পানি বাড়ছে। এই বর্ষায় অনেক এলাকার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাঁধ ভাঙলে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামত করে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে দাবি স্থায়ীভাবে বাঁধ মেরামত করতে পারলে এই এলাকার মানুষের উপকার হবে। তিনি বলেন, কয়রার বিভিন্ন এলাকায় ৬ কিলোমিটার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যা মেরামত করা খুবই জরুরি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী (আমাদী উপবিভাগ) সোলাইমান হোসেন বলেন, খুব দ্রুত বাঁধগুলো মেরামত করা হবে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

কয়রার পরই বেশি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের আরেক উপজেলা দাকোপ। শিবসা, পশুর, চুনকুড়ি আর ভদ্রার মতো বড় বড় নদী রয়েছে এই উপজেলায়। পলিমাটি দিয়ে তৈরি এসব নদ-নদীর বাঁধগুলোও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল গাজি বলেন, দাকোপ উপজেলার ৩৩ নম্বর পোল্ডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা যায়। রিমালে তার ইউনিয়নের বটবুনিয়া, কামিবিবাসিয়াসহ ৮টি স্থানে ভাঙন হয়, যা এখনও পুরোপুরি মেরামত হয়নি। এখন নদ-নদীগুলোর জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করেছে। বর্ষায় বাঁধগুলো অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। তাই বাঁধগুলো মেরামত করা খুবই জরুরি। দাকোপ উপজেলার নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, প্রতি বছরই দাকোপের ৩৩ নম্বর পোল্ডারে ভাঙন দেখা দেয়। এই ভাঙন রোধ করতে হলে প্রয়োজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় উপসহকারী প্রকৌশলী ননী গোপাল বলেন, বাঁধ মেরামতের জন্য পাউবো থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হবে। দ্রুত বাঁধগুলো মেরামত করা হবে। কয়রা আর দাকোপ উপজেলার মতো পাইকগাছা আর বটিয়াঘাটা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাঁধগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একটু পানির চাপ বাড়লে বটিয়াঘাটা আর পাইকগাছার ৮ থেকে ১০টি স্থানের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পাউবো সূত্রে জানা গেছে। তবে বাঁধগুলো যথা সময়ে মেরামত করা হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, কোনো এলাকার বাঁধ ভেঙে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে মেরামতের জন্য বিভিন্ন স্থানে বালুর বস্তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই উপজেলাগুলোর বাঁধ স্থায়ীভাবে মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

https://www.dailysangram.info/post/560643