৩০ জুন ২০২৪, রবিবার, ১০:৪০

১৬ বছরে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছে ২৪৮ জন

চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বেড়েছে অবৈধ বসবাস। পাহাড় কেটে বাড়ি করছেন ধনী লোকেরা। বড় লোকেরা থাকেন আলিশান ভবনে। পাহাড়ের পাদদেশে-ঝিলের পাড়ে থাকছেন গরীব লোকেরা। কেউ সেমিপাকা, কেউ টিনশেড ও কেউ বেড়ার কাঁচাঘরে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছেন। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এসব ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। সেখানে থাকেন একেবারেই স্বল্প আয়ের লোকজন। এসব অবৈধ বসতিতে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ।

প্রতিবছর বর্ষাকাল আসলে প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয়। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের কথা স্মরণ হয় তাদের। বছরের বাকি দিনগুলো পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের ব্যাপারে কোনো নজরদারি থাকে না। প্রশাসনের নজরদারি না থাকার সুযোগে দিনদিন বাড়ছে এ সংখ্যা। ফলে বাড়ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী নগরের পাহাড়গুলোতে বসবাসকারীদের সংখ্যা ৬ হাজার ৪শত ৫৬ পরিবার। নগরের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক বলে জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। ১৬ বছরে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছে ২৪৮ জন। তারা বলছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের স্থায়ী সমাধান না হলে প্রাণহানি আরও বাড়বে।
সংশ্লিষ্টদের সূত্র মতে, নগরের আকবর শাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন প্রায় ৪ হাজার ৪৭৬ পরিবার। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন নগরের মতিঝর্ণা ও বাটালী হিল পাহাড়ে ৪৩১ পরিবার, কৈবল্যাধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে ১৪৬ পরিবার, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ ১২ পরিবার, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৫ পরিবার, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪ পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬ পরিবার, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮ পরিবার, আমিন জুট মিলস কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ৬৫ পরিবার, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮ পরিবার, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২ পরিবার, আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার বসবাস করছে।

নগরে লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩ পরিবার, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪ পরিবার, নাছিয়াঘোনা এলাকায় ১২ পরিবার, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯ পরিবার, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচ পরিবার, নাগিন পাহাড়ে ২৫ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮ পরিবার, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অঙিজেন) ১১ পরিবার।

গত ২০ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮ তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম পাহাড়ে সব অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে এবং পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতি রোধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চট্টগ্রামে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে প্রতিবছরই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই বছর ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, শহরের কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝরনা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওই দিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়।

২০২২ সালে ১৭ জুন পাহাড়ধসে নিহত হয় আরও চার জন। ওই দিন রাত ২টায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় নগরের আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও পাঁচ জন আহত হন।

২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মা-মেয়ে।

২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরের আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশু প্রাণ হারায়। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড় ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও ১২১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সবমিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৬ বছরে নগরে ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৪৮ জন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় ধসে এত প্রাণহানির পরও বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা, দখল ও বসতি স্থাপনা।

https://dailysangram.info/post/559943