৩০ জুন ২০২৪, রবিবার, ১০:৩৪

বৃষ্টিতে আবারও বন্যার আশঙ্কা ডুবতে পারে আরও কয়েকটি জেলা

এখন মধ্য আষাঢ়, বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ রোববার ১৬ আষাঢ়। গত দু’সপ্তাহ ধরে সারাদেশে মৌসুমী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেই সাথে কোন কোন জেলায় ভারি বর্ষণও হচ্ছে। এতেই আবারও নতুন করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। কয়েক দিন আগেই বন্যা দেখা দিয়েছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে। তলিয়ে গিয়েছিল নদী তীরবর্তী অঞ্চল। টানা কয়েক দিনের ভোগান্তির পর নদ-নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে এর রেশ না কাটতেই আবারও ধেয়ে আসছে বন্যা। এদিকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতেও বৃষ্টির কারণে বন্যা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টিতে উজানের পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রসহ ওই অঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। এরই মধ্যে নদীগুলোর অনেকগুলো চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।

এদিকে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল শনিবার (২৯ জুন) সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে এ কথা বলা হয়। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। আর এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ফের বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইন্ডিয়া মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) তথ্যমতে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১শ' ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, জুলাইয়ের প্রথম দিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নদীর পানি বেড়ে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানির সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সিলেটের চার জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বিভাগে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে গত বুধবার পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। এর আগে টানা ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের ফলে সিলেটের সমতল আর নি¤œাঞ্চলের বাসিন্দারা বন্যায় তলিয়ে যায়। উজানের পানির কারণে দুটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাব।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কোথাও পানি কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীগুলোর পানি আগের তুলনায় নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারি এবং আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সারিগোয়াইন নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কতিপয় নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।

আবহাওয়া অফিস থেকে বলা হয়েছে, সারা দেশে আগামী ৫ জুলাই পর্যন্ত অতিবৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়াও ২০২২ সালের পর পুনরায় ২০২৪ সালে বন্যায় তলিয়ে গেছে বৃহত্তর সিলেট। টানা ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের ফলে সমতল আর নি¤œাঞ্চলের বাসিন্দারা বন্যায় ভেসে চলেছে। যদিও মাঝে মাঝে ভারি বৃষ্টি না দেখা দিলেও উজানের পানির কারণে দুটি নদীর ৬টি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে সিলেটের বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় অবস্থান করছে। তলিয়ে গেছে বাসা-বাড়ি, গবাদি পশু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাটসহ ক্ষেতের ফসলাদি। বেঁচে থাকার জন্য মানব জীবনের যা যা প্রয়োজন সবই মহা সংকটে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। প্রাণে বাঁচতে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ছুটছে অবিরত। তবে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভাটি এলাকায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলেও এখনো দুই নদীর ৬টি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে টিকতে না পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ।

জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে, সিলেট জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানিতে গোয়াইনঘাটের বিছানাকান্দিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জুয়েল মিয়া নামের এক দর্জির মৃত্যু হয়েছে এবং বুধবার রাত ৮টায় ফতেহপুরের বাংলাবাজার থেকে নৌকা ডুবে বন্যার পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জানা যায়, সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘিরপাড়, উপশহর, যতরপুর, সোবহানিঘাট, মিরাবাজার, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, তোপখানা, বেতেরবাজার এলাকার রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, পানি আগের থেকে কিছুটা কমলেও বৃষ্টি শুরু হলে আবার বেড়ে যাবে।

জৈন্তাপুর এলাকার বাসিন্দা শাহিদ হাতিমি বলেন, আমার উপজেলার কিছু মানুষের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। তবে বেশিরভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনো বন্যার পানি রয়েছে। আমি সিলেট শহরে বাসা নিয়ে থাকি। ঈদের আগেরদিন এলাকায় এসেছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বাসার আসবাবপত্রসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পানিতে তলিয়ে গেছে। উপশহরের বাসিন্দা কাজী জুবায়ের আহমেদ বলেন, ঈদের দিন বাসার নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছিল। পানির জন্য ঠিকমতো ঈদের আনুষ্ঠানিকতা করা হয়নি। বৃহস্পতিবারও বাসায় পানি রয়েছে। বন্দীর মতো দিনকাল যাচ্ছে, তবে পানি একটু কমছে।

উত্তরবঙ্গে বন্যা বাড়ার বিষয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, উজানের ঢলের সঙ্গে টানা বৃষ্টির পূর্ভাবাস থাকায় রংপুর বিভাগের সব নদ-নদীর পানি আরও কয়েকদিন বাড়বে। এতে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট জেলার আরো ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বন্যা কতখানি দীর্ঘমেয়াদি হবে তার কোনো সুস্পষ্ট অনুমান করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজের সব গেট দিয়ে উজানের পানি নামছে। ফলে তিস্তার পানি যেমন বেড়েছে তেমনি অন্যান্য নদীর পানিও বাড়ছে। সেই সঙ্গে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা আরও কয়েকদিন রয়েছে। তাই আগামী তিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে গুরুতর পরিস্থিতির দিকে যাবে না বলেও মনে হচ্ছে। এছাড়াও কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন কাঁচা সড়ক। ডুবে গেছে বাদাম, পাটক্ষেত, ভুট্টা, মরিচ ও শাক-সবজি ক্ষেতসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল। বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। লালমনিরহাটে এখনও পানিবন্দী রয়েছে অন্তত ৭ হাজার পরিবার। সেখানে তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ায় চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে বহু গুণ ।

ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আগেরদিন রাতে বুড়িতিস্তা নদীর বাঁধ ভেঙে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৭টি গ্রামের লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন দুই শতাধিক পরিবার। এছাড়া বালু পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় এক হাজার বিঘা কৃষিজমি ও আমন ধানের বীজতলা। ওই সাতটি গ্রাম ছাড়াও নীলফামারীর অনেক নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার নদীগুলোর পানিও বেড়েছে। নি¤œাঞ্চলে পানি উঠায় ও উঠার আশঙ্কায় অনেকে অপরিপক্ব ধান ও ফসল সংগ্রহ করে ফেলছেন। অনেকস্থানে মানুষ পানিবন্দী থাকার কথাও আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুড়িগ্রাম জেলার প্রধান দুই নদী ধরলা ও তিস্তার পানি যেভাবে বাড়ছে তেননি হু হু করে বাড়ছে দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও। প্রধান দুই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করবে।

https://dailysangram.info/post/559963