২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার, ১১:৫৩

আমরা কোথায় যাবো?

‘আমার বাবার জন্ম এখানে, দাদার জন্ম এখানে। আমার সারাটা জীবন চলে গেল। ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে উঠেছে এই মিরনজিল্লা সুইপার কলোনিতে। এখন হঠাৎ করে কোনো নোটিশ ছাড়াই আমাদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়া হলো। ঘর থেকে মালামাল সরানোর পর্যন্ত সময় দিলো না। দৌড়ে ঘর থেকে বেড় হয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। এখন থাকার জায়গা নেই। গত ১১ই জুন থেকে এভাবেই পরিবারের পাঁচজন সদস্য নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে দিন কাটাচ্ছি। বাইরে থেকে খাবার এনে কোনোরকম খাচ্ছি। কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এই বয়সে এসে আমাদের সঙ্গে এমনটা হবে।

হরিজন বলে কেউ আমাদের ঘরও ভাড়া দেয় না। এখন এই ৪শ’ বছরের বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে আমরা কোথায় যাবো?’ এভাবেই অশ্রুশিক্ত হয়ে গতকাল নিজের ভাঙা ঘরে বসে কথাগুলো বলছিলেন পুরান ঢাকার বংশালের আগা সাদেক রোডের পাশের মিরনজিল্লা কলোনির বাসিন্দা গোপাল দাস।

চার হাত/তিন হাতের ভাঙা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে ষাটোর্ধ্ব গোপাল দাস বলেন, এইটুকু ঘরের মধ্যে আমি, আমার স্ত্রী কাজল রানী, ছেলে বিশাল, মেয়ে বিশাখা ও ভাই জয়পালকে নিয়ে থাকতাম। এখানেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, এখানেই বুড়ো হয়েছি। এই কলোনিতে চার থেকে পাঁচ হাজার লোকের বসবাস। প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ সিটি করপোরেশনের হয়ে ময়লা-আবর্জনা পরিস্কারের কাজ করে। তারপরও কোনো থাকার ব্যবস্থা না করেই আমাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নেয়া হচ্ছে। গোবিন্দ লাল আরেক হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য বলেন, খাবার তো দূরে থাক আমরা কারওর দোকানে পানি খেতে গেলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। রাজেশ নামে মিরনজিল্লা সুইপার কলোনির আরেক বাসিন্দা। বলেন, দেশে আইন-কানুন আছে। কারওর উচ্ছেদের অন্তত এক মাস আগে নোটিসের মাধ্যমে জানাতে হয়। কিন্তু কোনো কথা ছাড়াই আমাদের কলোনির দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়। এরপর বুলডোজার দিয়ে এক একটি ঘর চুরমার করে দেয়া হয়। সে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমাদের টানা ১২ ঘণ্টা প্রতিবাদের মুখে সেদিন রাতে পিছু হটে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। তবে মাইকিং করে যায় পরের দিন আবারো উচ্ছেদ অভিযান চলানো হবে। কখন আবার কি হয় এই আতঙ্কে দিন পার করছি। ঘর হারানোর ভয়ে অন্যদের চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। সালমান নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই দেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের জায়গা হয়। তারা ঘর পায়, খাবার পায়, রেশন পায়। আর আমরা এদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদেরকে ঘর থেকে বিতারিত করা হচ্ছে। আমরা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবো? কমল নামে এক বাসিন্দা বলেন, কাঁচাবাজারের জন্য আগেই ১৭ শতাংশ জায়গা রয়েছে। নতুন করে মাত্র ১০ শতাংশ জমি প্রয়োজন। কিন্তু তারা আমাদের পুরো কলোনিই উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৭০ থেকে ৮০টি ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ বলছে, মিরনজিল্লা সুইপার কলোনিতে করপোরেশনের প্রায় ৩ দশমিক ২৭ একর জমি আছে। কলোনির ১৭ শতাংশ জমিতে থাকা কাঁচাবাজারটিকে এখন আধুনিক কাঁচাবাজারে রূপ দিতে চায় সিটি করপোরেশন। এজন্য ২৭ শতাংশ জমি প্রযোজন। সেই জমির জন্যই গত ১১ই জুন সেখানে উচ্ছেদ অভিযানে যায় সংস্থাটি। কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের তীব্র আপত্তি ও বাধার মুখে সেদিন একটি দেয়াল ও কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে ফিরে যায় উচ্ছেদকারীরা। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মিরনজিল্লা কলোনিতে বসবাসরতদের মধ্যে যারা সিটি করপোরেশনের কর্মচারী, তাদের নতুন ভবনে বাসা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে মহানগর পূজা উদ্‌যাপন কমিটি বংশালের সভাপতি এবং হরিজন সেবক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহেশ লাল রাজু ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রিপন কুমার দাস বলেন, যাদের ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের জন্য তেমন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়নি।

https://mzamin.com/news.php?news=115479