২৩ জুন ২০২৪, রবিবার, ৫:৩০

চাপে বেসরকারি বিনিয়োগ

বাজারভিত্তিক করায় সুদহারে পাগলা ঘোড়া

আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সুদহার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এরই সুবাদে তিন মাসের ব্যবধানে ঋণের ভারিত গড় সুদহার ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ঋণের সুদহারের এ পাগলা ঘোড়ায় সবধনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এমনিতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এর ওপর সুদহার বেড়ে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাজার প্রতিযোগিতায় তারা টিকে থাকতে পারছেন না। অনেকেই লোকসান গুণছেন। আর এ কারণে কেউ লোকসানের ধকল সামলাতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুনে সুদহার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সেই হতেই আমানত ও ঋণের সুদহার ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। তফসিলি ব্যাংকগুলোতে গত ডিসেম্বর শেষে আমানতের ভারিত গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঋণের সুদহারও বেড়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ঋণের ভারিত গড় সুদহার যেখানে ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ, সেখানে তিন মাসের ব্যবধানে মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সুদহারের নূ্যূনতমসীমা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের জুন শেষে এ সংক্রান্ত এক নির্দেশনা দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। গত বছরের ১৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক সার্কুলার জারি করে সুদহারের নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। তখন ছয় মাসে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সাথে অতিরিক্তি ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করে নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়। তখন ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় এ সুদহারের ব্যবস্থাকে ইসমার্ট নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু আইএমএফ থেকে এ পদ্ধতিতেও আপত্তি করা হয়। কারণ, এটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল। এ কারণে গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন সুদহার ব্যবস্থা প্রবর্তনের নীতি প্রত্যাহার করে এক সার্কুলার জারি করা হয়। নতুন এ সার্কুলার অনুযায়ী সুদহার সম্পূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক করা হয়। আর এ জন্য ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা ও জোগানসাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বর্তমানে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি আমানত সুদহারে নিম্নসীমা প্রত্যাহার করে স¦ীয় বিবেচনায় সুদহার নির্ধারণের জন্যও নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এর ফলে আমানতের সুদহারও বাড়তে থাকে।

মূলত সুদহার বাজারভিত্তিক করার পর থেকেই সুদহারের পাগলা ঘোড়া ছুটতে থাকে। প্রতি মাসেই সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট রয়েছে। আর এ সঙ্কট মেটাতে আমানতের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে গেছে। সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডের সুদহার উঠেছে। এ কারণে ব্যাংকের আমানতের সুদহার বেড়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত আমানতের সুদহার পরিশোধ করছে। আর আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে। ১০ শতাংশ আমানতের সুদ হারের সাথে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৩ শতাংশও যুক্ত হলে হয় ১৩ শতাংশ। আর ১২ শতাংশের সাথে ৩ শতাংশ যুক্ত হলে হয় ১৫ শতাংশ। এর ওপর রয়েছে নানা সার্ভিস চার্জ। সবমিলেই বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আর বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাসও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে ডলারের দাম। ৮৫ টাকার ডলার এখন কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা থেকে ১২২ টাকা। এতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। বেড়েছে ঋণের সুদহার। সবমিলেই সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিদেশী পণ্যের সাথে মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এতে মুনাহার হার কমতে কমতে এখন অনেকেই লোকসান গুনছেন। আর লোকসানের ধকল কাটাতে না পেরে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারেও পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতি তাদের এখন টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। চলমান পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য ব্যবসা ব্যয় কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/844297