২১ জুন ২০২৪, শুক্রবার, ৭:৫৭

চামড়ায় শকুনের থাবা

‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবি এই কবিতার গরিবের সম্পদের প্রতি রাজার লালসার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে যারা সিন্ডিকেট করে গরিবের হক চামড়া টাকা খাচ্ছেন তারা শত কোটি টাকার মালিক হলেও মানসিকতায় ফকির মিসকিন বটে। এক দশক থেকে এই টাকাওয়ালা ফকিরেরা সিন্ডিকেট করে কোরবানির চামড়ার দাম কমিয়ে গরিবকে ঠকাচ্ছেন। এবারও পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চতুর্মুখী সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে দেশের চামড়ার বাজার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়া কেনাক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগীদার হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিন।

কোরবানির পশুর চামড়ার হকদার হলো প্রতিবেশী ফকির-মিসকিন, গরিব আত্মীয়-স্বজন ও মাদরাসা পড়–য়া বাবা-মাহারা এতিম। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় ঈদুল আযহায় যারা পশু কোরবানি দেন তাদের কেউ পশুর চামড়া স্থানীয় মাদরাসায় দান করেন; কেউ বিক্রি করে অর্থ ফকির-মিসকিন ও মাদরাসার গরিব ছাত্রদের জন্য দান করেন। কোরবানির চামড়ার দানের অর্থে চলে হাজার হাজার মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং। সমাজের দানশীল ও বিত্তবান ব্যক্তিদের অর্থে গড়ে ওঠা মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো শত শত বছর ধরে এভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শত শত বছর ধরে এই রেওয়াজ রাজধানী ঢাকাসহ শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই। লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর খরচের বড় অংশ আসে সাধারণ মানুষের কোরবানির পশুর দানকরা চামড়ার অর্থ থেকে। কিন্তু সেই গরিবের হক কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছেন সম্পদশালী ব্যবসায়ী, ফড়িয়া এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় উপনেতা, পাতি নেতারা। মিসকিন ও মাদরাসাপড়–য়া ইয়াতিমদের হকের ওপর থাবা বসানো হয় কোরবানির ঈদের আগেই। কোরবানির আগেই চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম কমিয়ে দেন। ২০১২ সালের পর থেকে চলছে এই খেলা। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় কোরবানির চামড়ার টাকার প্রকৃত হকদার পাড়া-মহল্লার গরিব মানুষ ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে এতিম তালেবে ইলমরা বঞ্চিত হচ্ছে। কোরবানির চামড়ার ওপর শকুনের থাবায় চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ছে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা মাদরাসাপড়–য়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। সমাজের বিত্তবানদের দানে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিয়ে তাই অনেকেই বিপাকে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২শ’ থেকে ৬শ’ টাকায়। কোনো কোনো এলাকার লোকজন চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুতে ফেলেছেন। আবার কোনো কোনো এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে দিয়ে দিয়েছেন গরিব লোকজনকে। কিন্তু চামড়া নিয়ে সেই গরিব লোকজনও বিপাকে পড়েছেন মূল্য না পেয়ে। এবার পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় গরিবের হক সিন্ডিকেটে খেয়েছে বলে বলছেন অনেকে। ট্যানারি মালিক ও আড়তদার সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে পড়েছে কাঁচা চামড়ার বাজার। তারা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। ফলে এবারও সরকারের বেঁধে দেয়া দরে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়নি। শুধু তাই নয়, ট্যানারি মালিক ও আড়তদার সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানিদাতারা সরকারের বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেকও পাননি। কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে কমে চামড়া কেনার পরও লোকসান গুনেছেন। আড়তদাররা তাদের ইচ্ছেমতো দামে চামড়া কিনেছেন খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার চামড়া শিল্পকেও ধ্বংস করে গরিব ও অসহায়দের হক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকার লোক দেখানো চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে যা খুবই সামান্য। কিন্তু এ দামেও কেউ চামড়া ক্রয় না করে পাটের মত চামড়াকেও ধ্বংসের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে। চামড়ার ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কোরবানির চামড়ার ভয়াবহ দরপতন হয়। সরকার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পাট শিল্পের মত চামড়া শিল্পকেও ধ্বংসে কাজ করছে। এতে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এতিম, অসহায় মাদরাসার এতিমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়লো। অপরদিকে কওমি মাদরাসা যা সরকারের কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই দেশের শিক্ষাখাতে অসামান্য অবদান রাখছে, সে কওমি মাদরাসাগুলোকে ধ্বংসের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে কাজ চলছে। কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক এতিম-গরিব ও মিসকিনসহ সমাজের প্রান্তিক দরিদ্রজনগোষ্ঠী। প্রতি বছর চামড়ার দরপতনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এতে বিঘিœত হয় দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া এমনটাই জানালেন তারা।প্রতি বছরের মতো এবারো পশু কোরবানির পর পাড়া-মহল্লা থেকে গরু ও খাসির চামড়া কেনেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গতবারের চেয়ে এবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৭ টাকা বাড়ানো হলেও কাক্সিক্ষত দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও চামড়া কেনাবেচা হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। সরকার নির্ধারিত লবণযুক্ত চামড়ার দামের অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়া সস্তা দামে বেচা-কেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি কেউ। হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় মোটা অংকটাই সিন্ডিকেটের কবজায় চলে গেছে।সরকারের বেধে দেয়া চামড়া দাম নির্ধারণ শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকায় সিন্ডিকেট বলয় এবারও ভাঙতে পারেননি সাধারণ ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরো চামড়ার বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নেন আড়তদারসহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের ফাঁদ পাতানো ব্যবসায়ীরা গরিব দুঃখীর হক সংকুচিত করে প্রতিবছর লুটে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

সচেতন মহল বলেছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারলে গরিব-দুঃখীরা তাদের হক বঞ্চিত হবেন। তেমনি কোরবানির পশুর চামড়া মাটিচাপা দেয়া রীতিতে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করে চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা জানিয়েছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া কিনে আনার পর আড়তদারদের কাছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এতে করে হতাশ তারা।এক মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা নিজেরাও সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে থাকেন। চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের দেন। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন ট্যানারি মালিকদের কাছে এখন তাদের অনেকেই জিম্মি। বিগত কয়েক বছর ধরে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

জানা গেছে, রাজধানীর লালবাগে পোস্তায় এবার কোরবানির ঈদে ১ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। আড়তদারদের সং গঠনের নেতারা বলছেন, কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ-সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এবার বড় চ্যালেঞ্জ অতিরিক্ত গরম। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে দ্রুত লবণ ব্যবহারের পরামর্শ তাদের। পোস্তায় চামড়া সংগ্রহের পর লবণজাত করে সাভারের ট্যানারিগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন আড়তদাররা।

একজন আড়তদার জানান, সরকার নির্ধারিত দামে লবণযুক্ত চামড়া ফুট হিসেবে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে। এখন যেসব চামড়া আসছে সেটা লবণ ছাড়া সে জন্য এ চামড়ার দাম প্রতিফুট লবণযুক্ত চামড়া থেকে ৫ থেকে ৭ টাকা কমে ব্যবসায়ীরা কিনছেন। তবে শহরের চামড়া সন্ধ্যা ৬টা এবং শহরের বাইরের চামড়া যদি রাত ১০টার মধ্যে পোস্তায় আনা যায় তাহলে পচন রোধ করা যায়। সেই সঙ্গে দামও ভালো হবে। ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোরবানির চামড়া নষ্ট হয়।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, চামড়ার দাম নির্ভর করে গুণগত মানের ওপর। যথাযথভাবে চামড়া ছাড়ানো, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা না গেলে চামড়ার মান অটুট থাকে না। ফলে তার দামও তেমন থাকে না। এজন্য চামড়া ছাড়ানোর কাজে সংশ্লিষ্টদের অনভিজ্ঞতা এবং অসচেতনতাই দায়ী। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসমএ) সভাপতি মো. আফতাব খান জানান, তারা চেষ্টা করেছেন নির্ধারিত দামের ফর্মুলা মেনে চামড়া আড়তে তুলতে। কারণ, বর্গফুটপ্রতি লবণযুক্ত চামড়ার যে দাম ধরা হয়েছে, সেখানে কাঁচা চামড়া কেনার পর ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা প্রক্রিয়াজাত খরচ আছে। সেই টাকা বাদ দিয়েও আমরা ঢাকায় গরুর চামড়া পিস ও মানভেদে ভেদে ১ হাজার ৩০০ টাকায়ও কিনেছি। আবার ৪৫০ টাকায়ও কিনেছি।

ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা দাবি করেছেন, চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপিকে পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করা হয়েছে। এর সব মডিউলকে ওভারহোলিং তথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামতপূর্বক ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে তরল বর্জ্যকে পরিশোধন করা হয়েছে। তাছাড়া বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাথমিক পরিশোধন ছাড়া যাতে কোনো ট্যানারির বর্জ্য সিইটিপিতে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেন, সরকার লোক দেখানো কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে যা খুবই সামান্য। কিন্তু এ দামেও কেউ চামড়া ক্রয় না করে পাটের মত চামড়াকেও ধ্বংসের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে। কোরবানির চামড়ার বাজারে এবারও ভয়াবহ দরপতন। লাখ টাকার গরুর চামড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সেখানে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য মুল্য নির্ধারণ করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কোরবানির চামড়ার ভয়াবহ দরপতন হচ্ছে। সরকার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পাট শিল্পের মত চামড়া শিল্পকেও ধ্বংসে কাজ করছে। এতে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এতিম, অসহায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়লো। অপরদিকে কওমি মাদরাসা যা সরকারের কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই দেশের শিক্ষাখাতে অসামান্য অবদান রাখছে, সে কওমি মাদরাসাগুলোকে ধ্বংসের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে কাজ চলছে। ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা আরো বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক এতিম-গরীব ও মিসকিনসহ সমাজের প্রান্তিক দরিদ্রজনগোষ্ঠী। প্রতি বছর চামড়ার দরপতনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এতে বিঘিœত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া। সরকারের কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণ জনগণের সহযোগিতা নিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। যেখানে সাধারণ শিক্ষাখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগার থেকে ব্যয় হয়, কওমি মাদরাসাগুলোর পেছনে সরকারের এক পয়সাও খরচ নেই। বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠীকে কেবল মাত্র জনগণের সহযোগিতায় শিক্ষা প্রধান করে কওমি মাদরাসাগুলো দেশ, ইসলাম ও মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখছে। কোরবানির চামড়ার দরপতনে কওমি মাদরাসাগুলো ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হল। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরস্থ জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কমিয়ে এতিম-গরিবদের হক আত্মসাৎ করছে ট্যানারি মালিক ও কতিপয় অসাধু চামড়ার ব্যবসায়ীরা। যে চামড়ার মূল্য ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা সিন্ডিকেটের কারণে বর্তমানে এর মূল্য ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মাত্র। সরকারের তদারকি না থাকার কারণে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ধার্যকৃত মূল্যের তোয়াক্কাও করেনা, তাদের ইচ্ছে মতো নাম মাত্র মূল্যে চামড়া খরিদ করছে। এতে করে দেশের শত শত কওমি মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডং এর এতিম,গরিব,অসহায়- দরিদ্র শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোরবানির চামড়ার মূল্যের হকদার প্রতিম গরিব ও অসহায় মানুষ। কোরবানির চামড়ার মূল্য কমিয়ে দিয়ে মূলত তাদের হক নষ্ট করা হচ্ছে। মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী আরো বলেন, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ এতিম-গরিব, অসহায় ও পথ শিশুদেরকে শিক্ষা, বাসস্থান, লালন-পালনসহ সকল খরচ ব্যবস্থা করে আদর্শ নাগরিক হিসেবে তৈরি করছে কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ অসহায় দরিদ্র সন্তানদের এত বড় খরচ সরকারি অনুদান ছাড়া জনসাধারণের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে আসছে।

মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী আরো বলেন, কওমি মাদরাসাগুলো দেশকে আদর্শ নাগরিক উপহার দিচ্ছে। এ মাদরাসাগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি, মারামারি-কাটাকাটির কোন নজির নেই। অথচ সরকারি টাকায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নীতি নৈতিকতাহীন একশ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে দেশের সুনাম ক্ষুণœ করছে।

খুলনা জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মুফতি আব্দুল্লাহ ইয়াহইয়া বলেছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক খাত চামড়াশিল্পকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে একটি মহল। তা যেমনিভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তেমনি ভাবে কওমি মাদরাসার জন্যও ক্ষতিকর। কওমি মাদরাসার আয়ের অন্যতম প্রধান একটি উৎস হলো কোরবানির পশুর চামড়া। কিন্তু চামড়া ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছে। এতে কওমি মাদরাসার আয়ও কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে গরিব শিক্ষার্থীদের উপর। কওমি মারাসার ছাত্র-শিক্ষকরা ঈদের আনন্দ ত্যাগ করে ঈদের দিন অসহায় ও গরিব ছাত্রদের এলমে দ্বীন শিক্ষাসহ সার্বিক খরচ ব্যবস্থার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের এই মেহনত ও ত্যাগের বিনিময়ে হাজার হাজার পথশিশু, এতিম-গরিব সন্তান আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী একটি মহল কওমি মাদরাসার এই সফলতাকে মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কমিয়ে কওমি মাদরাসাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা সেই ষড়যন্ত্রের অংশ।

স্টাফ রিপোর্টার, শেরপুর সীমান্ত অঞ্চল থেকে জানান : শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলে পানির দরে বিক্রি হয়েছে কুরবানির পশুর চামড়া। গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় আসেনি মৌসুমি চামড়া ক্রেতারা। কুরবানিদাতারা হয় চামড়া ফেলে দেন। না হয় বিনামূল্যে এতিমখানাগুলোতে দিয়ে দেন। ২০১৯ সালের পর থেকে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এমন সংকট দেখা দেয় শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলে। চামড়া ব্যবসায়ী আড়তদাররা চামড়া কিনতেই চায় না। ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কোরবানিদাতা ইনকিলাবকে বলেন. ঈদুল আযহার দিন কুরবানির পশুর চামড়া কিনতে কেউ আসেনি। ফলে বাধ্য হয়েই স্থানীয় এতিমখানায় বিনামূল্যে দিয়ে দিতে হয়েছে কুরবানির পশুর চামড়া। কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এমন চিত্র দেখা দিয়েছে সীমান্ত অঞ্চলের সর্বত্রই। কেউ কেউ বলছে, লাখ লাখ টাকার কোরবানির পশুর চামড়া বিনামূল্যে অথবা পানির দরে বিক্রি করতে হয়। ২/১শ’ টাকায় কুরবানি দাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ওই চামড়া আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে গেলে তারা অর্ধেক দামে কিনতে চায়। ৬শ’ টাকা চামড়া ৩শ’ টাকায় কিনেছেন। গত ৪-৫ বছর ধরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করতে আগ্রহী নন।

এ বছর কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করলেও বিক্রি করতে পারেনি তারা। বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই অবশেষে মাটিতে পুতে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, আড়তদারদের নির্ধারিত দামেই তারা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন। আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। ফলে লোকসান গুণতে হয়েছে। অনেকে সেই ভোরে রাগে-দুঃখে ও হতাশায় চামড়া ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যান। ঝিনাইগাতী মাদরাসার এয়াতিমখানার স্বেচ্ছাসেবিরা কুরবানির দিন সকাল থেকেই বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। তারা এসব চামড়া একেবারেই কমদামে বিক্রি করেছেন আড়তদারদের কাছে।কয়েকজন মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহকারি বলেন, ৫শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকায় চামড়া কিনে ২শ’ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। এয়াতিমখানার লোকজন পাড়ায়-পাড়ায় লিল্লাহ ফান্ডের জন্য বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছে। সেই চামড়া তারা ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকায় বিক্রি করেছেন। সস্তায় কাঁচা চামড়া পেয়ে আড়তদাররা গ্রামাঞ্চলে আসেনি। কুরবানিদাতারা চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে থাকেন গরীব, অসচ্ছল, মিসকিন ও ভুখা-নাঙ্গা ব্যক্তিদের। তাদের হক থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। ন্যায্যমূল্যে কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে না গত ৪/৫ বছর ধরে। ফলে ৮/৫ বছর ধরে চামড়া বিক্রির টাকা পাচ্ছেন না এ সব অসহায় মানুষ।

ঝিনাইগাতীর বড় চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম জানান, মূলত পুঁজি সংকট ও সংরক্ষণের স্থান না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে চামড়া কেনেন ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী, মওসুমি ব্যবসায়ী ও পশুর চামড়ার মালিকরা। সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা জেলায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হলে ও চামড়া বিক্রি করতে গেলে সেই মূল্য দেননি ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষুব্ধ খুচরা চামড়া বিক্রেতারা। বিশেষ করে বিভিন্ন মাদরাসায় দানকৃত চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশ হয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষগণ।

https://dailyinqilab.com/national/article/666171