২১ জুন ২০২৪, শুক্রবার, ৬:৩৪

বন্যায় বিপর্যস্ত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল

বন্যাপ্লাবিত ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের একদিকে পাহাড়ি ঢল অন্যদিকে উজানেও বৃষ্টি ভাটিতেও বৃষ্টি। ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যার পানিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবন্দী লোকজনের আর্তনাদ বাড়ছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে খামারের মাছ ও হাঁস। আমন, আউশ, ইরি ধানি জমি পানির নীচে। নলকূপ নিমজ্জিত থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গো-খাদ্যের অভাবে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন, মসজিদ, মন্দির ও কবরস্থান প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদেরকে। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক জায়গায় চুলা-নলকূপও ডুবেছে। বন্যায় পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন জেলার ৬ লক্ষাধিক মানুষ।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত জেলার প্রধান নদী সুরমা, কালনী, কুশিয়ারা ও যাদুকাটা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে বুধবার বিকেল ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পানি স্থির রয়েছে। প্রথম দিকে জেলার ৩টি উপজেলা বন্যা কবলিত হলেও এখন সারা জেলার ১২টি উপজেলা ঢলের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। হাওড় এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, দিনে মাঝে মাঝে বৃষ্টি বন্ধ হলেও মুহূর্তেই কালো হয়ে উঠে আকাশ। নামে অবিরাম বর্ষণ এবং বর্ষণের সাথে শুরু হয় গর্জন। ভোগান্তি আর আতংক এখন সুনামগঞ্জবাসীর নিত্যসঙ্গী। একটানা ৪ দিন ধরে পাহাড়ি ঢলের সাথে লড়াই করে চলছেন বানভাসীরা। পানিবন্দী হয়ে পড়ায় অনেকেই বাসা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। আবার অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের দিনমজুর জলিল মিয়া বলেন, ২০২২ সালের ১৭ জুন শুক্রবার সাড়ে ১২টায় ইব্রাহিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অনাহারে মারা যান আমার পিতা জারীগানের শিল্পী মো.আশরাফ আলী। বন্যার পানিতে লাশ বেঁধে রাখা অবস্থায় ৬দিন পর কবরস্থানের মাটি পানিমুক্ত হলে আমার বাবার লাশ দাফন করি। এবারও আমাদের সেই বসতঘরটি সোমবার (১৭ জুন) পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে প্রথম দফার বন্যার পানিতে ডুবে যায়। আমরা সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছি আমাদের বোন সুরমা ইউপি সদস্যা তানজিনা বেগমের বসতঘরে।

বুধবার দিনব্যাপী সুনামগঞ্জ কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও জেলা আনসার ভিডিপি কার্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেওন্দ্রে শুকনো খাবারসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ছাতক উপজেলার জামুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয়,দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ হাজার পরিবারের মাঝে পুলিশ প্রশাসনের প্রস্তুতকৃত রান্না করা খাবার বিতরণসহ ত্রাণসামগ্রী প্রদান করেছেন সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের (ডব্লিউআরই) একটি ক্লাসে ড. তারেক বলেছিলেন, সিলেটের বন্যার কারণ ইটনা-মিঠামাইন সড়ক।

এ সড়ক নির্মাণে কোন হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে হয়নি। বৃহদাকার কোন নির্মাণ প্রজেক্ট করার আগে নদীর পানি প্রবাহ, পানির উৎস, বৃষ্টির পানি, হাওড়ের পানির উপর এর কি প্রভাব পড়বে এসব সার্ভে করতে হয় উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুনামগঞ্জের সিভিল সোসাইটির শত শত লোকজন দাবি করেন, জেলার বারংবারের বন্যার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ ইটনা-মিঠামাইন সড়কটি। যার প্রবল বাধার কারণে জেলার প্রধান নদী সুরমা কালনী ও কুশিয়ারার পানি মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হতে পারেনা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ছাতক উপজেলায় ১৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘন্টায় ভারতের মেঘালয়, আসাম ও চেরাপুঞ্জিসহ সীমান্তে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে। এতে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত কন্ট্রোলরুমের দায়িতপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান ইমন বলেন, জেলার ১১টি উপজেলায় ৬ লাখ লোক পানিবন্দী রয়েছেন। জেলার ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ হাজার বন্যার্ত ভিকটিম আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে জিআর ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও জিআর ক্যাশ হিসেবে ৩৫ লাখ টাকা।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের সুরমা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের জন্য ১০ মেট্রিকটন চাল এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দসহ বন্টন করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যাপ্ত মরিমাণ ত্রাণসামগ্রী মজুত আছে। জেলা প্রশাসন বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে গত চারদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার কলমাকান্দায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আর এতে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন কলমাকান্দা উপজেলার নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক। পানি ঘরবাড়িতেও প্রবেশ করছে। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এসব এলাকার মানুষদের। এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

নেত্রকোনায় প্রধান প্রধান নদীগুলোর মধ্যে কংশ, সোমেশ্বরী, ধনু নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে থাকলেও উব্ধাখালী নদীর পানি ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কলমাকান্দায় উব্ধাখালি নদীর পানি বেড়ে উপজেলার আটটি ইউনিয়নে ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে সদর, বরখাপন ও পোগলা ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা এবং কৈলাটি, রংছাতি ও খারনৈসহ বাকি পাঁচটি ইউনিয়নের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু কাঁচা পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এভাবে টানা বৃষ্টি হতে থাকলে অবনতি হতে পারে বন্যা পরিস্থিতির। এদিকে নিম্নাঞ্চলের রাস্তা ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ঘরবন্দী আছেন বৃদ্ধ, শিশু ও গবাদিপশু। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে বসতঘরে পানি ওঠার এবং সুপেয় পানি, ও খাবার সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ জানান, বন্যা মোকাবিলায় ২৪৫টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটিতে ৩৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া শুকনো খাবার, উদ্ধারকারী দল, মেডিকেল টিমসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী ও হাকালুকি হাওড় পাড়ের উপজেলা জুড়ীতে বন্যা দেখা দিয়েছে।

ঢলের পানিতে উপজেলার নদনদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে মৌলভীবাজারের জুড়ী শহর ও উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ইতোমধ্যে অর্ধলক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। বন্যায় উপজেলার জায়ফরনগর ও পশ্চিমজুড়ী ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বলেও ফুলতলা, সাগরনাল, পূর্ব জুড়ী ও গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। এছাড়া জুড়ী টু ফুলতলা ও জুড়ী টু লাঠিটিলা আঞ্চলিক মহাসড়কে বন্যার কারণে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু এলাকার সড়ক। সেই সঙ্গে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট, মাছের ঘের। এদিকে, ঢলের পানি উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওই অঞ্চলের মানুষজন। অনেকেই তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা উঁচু এলাকায় আত্মীয় স্বজনদের বাসায় ছুটছেন। নিম্নাঞ্চলের মানুষদের অনেকেই জানিয়েছেন, ঢলের পানিতে তাদের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। এখন নিরুপায় হয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সমরজিৎ সিংহ বলেন, বন্যার্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য ৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, বন্যায় ইতিমধ্যে উপজেলার ৬৫ গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জুড়ীতে ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২৩১ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি বলেন, জুড়ীতে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় আমরা শুকনো খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে। বড়লেখা-জুড়ী আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, বন্যা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের মাঝে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

আমাদের মৌলভীবাজার সংবাদদাতা আরো জানান, অবিরাম বর্ষণে ও ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজার জেলার ৬টি উপজেলায় বন্য দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী হয়েছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। জেলার সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকার অধিকাংশ গ্রামীন রাস্তা তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। বাড়ি ঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। অনেকেই আবার নিজের বাড়ি-ঘর রক্ষায় সেচ্ছাশ্রমে বাঁধের উপর বালির বস্তা ফেলছেন। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মনু নদীর পানি শহরের চাঁদনীঘাট এলাকায় বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার, ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ২০২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসন উর্মি বিনতে সালাম জানান বন্যায় জেলার ৬ উপজেলা মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩৭ ইউনিয়নের ৪৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী রয়েছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। ৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ৫৭১টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন।

সিলেটে পানি কোথাও কমছে কোথাও বাড়ছে ॥ দুর্ভোগ অব্যাহত
সিলেট ব্যুরো: সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ভাটি এলাকায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। জেলার প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি সকাল থেকে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। চার জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, বিভাগে অন্তত ১৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কোথাও পানি কমেছে, আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীগুলোর পানি আগের তুলনায় নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, মহানগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সিলেট জেলা-নগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের ২২৩ টি গ্রামের ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যা কবলিত। তার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ১ হাজার ৪৪০ জন মানুষ। উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সাথে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সকল সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারতেছে না। সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিলেটে আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।

গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানিবৃদ্ধি ॥ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী: উজানের পানিতে গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অপরদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারি, ঘাগোয়া ও ফুলছড়ি উপজেলার এরান্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি ও ফজলুপুর এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ও হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করছে। নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সদরের মোল্লার চর ও ফুলছড়ির ফজলুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে ৫২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৪৪ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসান বলেন, আগামীকাল জেলা ও উপজেলায় দুর্যোগকালীন মিটিং ডাকা হয়েছে। নদী বেষ্টিত যে চারটি ইউনিয়ন রয়েছে। সেই সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ প্রত্যক্ষ সদস্যদের বলে দেওয়া হয়েছে নদীর পাড় পার্শ্ববর্তী যেসব ওয়ার্ড আছে সেখানে গ্রুপ ভিত্তিক ভলেন্টিয়ারের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখার জন্য। এছাড়া ওসব এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাথমিক সব প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

রংপুর অঞ্চলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
রংপুর অফিস: ভারী বর্ষণ এবং ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুর অঞ্চলে প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। অন্য নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, উজানের ঢল আর গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বাড়ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গত বৃহস্পতিবার ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার ভোর থেকে ভাটির দিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এদিকে পানি বাড়ার সথে জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পাউবো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর অনেকে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের পানি প্রবেশ করে তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক আর এলাকার বিভিন্ন ফসল ও সবজি ক্ষেত। দুভোর্গে দিন যাপন করছে অনেক দিনমজুর পরিবার।

পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, রংপুর জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে একই সময়ে পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব পানিয়ালের ঘাট এলাকায় চরের অধিকাংশ জমি পানির নিচে। উপজেলার গাবুড়ার চরের কৃষক জাফর আলী জানান, প্রায় ৭ একর জমিতে বাদাম চাষ করে তা নদীর পানিতে বাদাম তলিয়ে গেছে। কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। কৃষক মুকুল মিয়া প্রায় ২ একর জমিতে বাদাম চাষ করে। সে বাদাম অর্বধেক পানির ¯্রােতে ভেসে গেছে। কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই গ্রামের বাসিন্দা মজিরন নেছা জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিস্তা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার গত দুই সপ্তাহে বসতঘর ও স্থাপনাসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েকশ’ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মাঝে দুর্ভোগের আতঙ্ক রয়েছে। নদীর তীরবর্তী আবাদি জমিগুলো তলিয়ে গিয়ে বাদাম ও শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পানি বাড়ার ফলে গবাদি প্রাণী ও মানুষ বিপাকে পড়েছে।

পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন বলেন, আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বন্যাসংক্রান্ত প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে বা গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে।

কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক বলেন, উজানের ঢলে বন্যায় যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুুতি নেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের মানুষের পরিস্থিতির খোঁজ-খবর রাখতে বলেছি। কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হলে সরকারিভাবে তাদের সহায়তা করা হবে। গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না জানান, নদীর চরাঞ্চলে বসবাস করা বাসিন্দাদের উঁচু জায়গায় গবাদি প্রাণীসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের ঢল আর গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারেজের সবকটি গেটই খুলে রাখা হয়েছে। রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুুতি নিয়েছেন তারা। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন জানান, বন্যায় সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছেন।

https://www.dailysangram.info/post/559150