১৬ জুন ২০২৪, রবিবার, ১১:২৫

হজ্বের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা॥ ফিলিস্তিনের জন্য দোয়া

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাতের ময়দান। মিনা থেকে আরাফাত প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ ছেয়ে যায় ইহরামের শুভ্রতায়। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বাসে করে আবার কেউ কেউ ট্রেনে যান আরাফাতের ময়দানে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে সৌদি আরবের মক্কার অদূরে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হয়েছেন প্রায় ২০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলিম। সেখানে মসজিদে নামিরায় হজের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন হজের ইমাম। এছাড়া নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছেন। দোয়ায় ফিলিস্তিনিদের স্মরণে রাখতে মুসলিম উম্মাহর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ সময় গতকাল শনিবার বিকেল সোয়া তিনটার দিকে খুতবা শুরু হয়। চলে প্রায় আধাঘণ্টা। এবার হজের খুতবা দেন মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব ড. শেখ মাহের বিন হামাদ। বাংলাসহ প্রায় ৫০টি ভাষায় এটি অনুবাদ করে শোনানো হয়।
আরবি বর্ষপঞ্জি অনুসারে ৯ জিলহজ পবিত্র ‘আরাফাত দিবস’ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক এই ময়দানে দিনব্যাপী ইবাদত বন্দেগি আর দোয়া মোনাজাতে মশগুল হাজিরা। এদিন সকাল থেকে কণ্ঠে তাদের সমস্বরে উচ্চারিত হয়, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি মাতা লাকা ওয়াল্মুল্কু, লা শারিকা লাকা’। অর্থ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার’।

সাদা দুই টুকরা কাপড়ে শরীর ঢেকে হজ¦যাত্রীরা শনিবার মিনায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকেই পবিত্র আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওনা করেন। এই আরাফাতের ময়দানেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই স্মৃতি বুকে ধারণ করে মুসলিমরা সমবেত হন এই পবিত্র প্রান্তরে।

গত শুক্রবার মক্কা থেকে পাঁচ থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করেন হজ¦যাত্রীরা। সেখানে ইবাদত বন্দেগিতে দিন ও রাত পার করেছেন তারা। সেখান থেকে শনিবার ভোরে তারা আল্লাহকে কাছে পাওয়ার এক তীব্র আকাক্ষায় ছুটে আসেন আরাফাতের ময়দানে। মুহুর্মুহু উচ্চারণ হতে থাকে, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্, লা শারিকা লাকা’। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

হজের খুতবায় মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়েখ মাহের আল মুয়াইকিলি বলেছেন, ইসলাম অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কাউকে খারাপ নামে ডাকবে না। মুসলমানদের উচিত পরস্পরকে সৎকাজে সহযোগিতা করা, ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলার মাঝেই আছে সঠিক পথের দিশা।

তিনি আরও বলেন, একে অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত, অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করা ঠিক নয়, আল্লাহ বলেন, ন্যায়ের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিন, মদ ও জুয়া মন্দ কাজ।

মসজিদুল হারামের ইমাম হজের খুতবায় আরও বলেছেন, নিজের পিতা-মাতা এবং যে আপনার প্রতি দয়া ও সদ্ব্যবহার করেছে তার জন্য দোয়া করুন। এবং দোয়া করো এবং অন্যের জন্য তার অনুপস্থিতিতে করুন, তাহলে ফেরেশতাও আপনার জন্য দোয়া করবেন।

খুতবায় ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে তুলে ধরে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের মুসলমানেরা যুদ্ধে কবলে। তারা বিপর্যস্ত। তাদের খাওয়ার পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, পৃথিবীর সবধরনের আরাম ও সুখ থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের জন্য দোয়া করুন। বিশ্ব মুসলিমের কাছে এটা তাদের পাওনা।

তিনি বলেন, যারা ফিলিস্তিনিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন, সহযোগিতার চেষ্টা, অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সহযোগিতা করছেন, করছেন তারাও দোয়ার হকদার। এছাড়াও যারা হজ¦যাত্রীদের সেবা করছেন তারাও দোয়ার হকদার।

খুতবায় ইমাম মুসলমানদের তাকওয়ার জীবন অবলম্বনের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, তাকওয়া মানুষকে সফলতা ও মুক্তি দেয়, তাকওয়া অবলম্বনকারীরা কেয়ামতের দিন দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত থাকবেন। যে তাকওয়া অবলম্বন করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন যেখান থেকে সে কল্পনাও করতে পারবে না। যে তাকওয়া অবলম্বন করবে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে তাকে প্রতিদান দেবেন।

হজের খতিব বলেন, আল্লাহ তায়ালা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তারা নবীজি (সা.)-কে সম্মান করবে, ঈমান আনবে এবং আল্লাহ হেদায়েত স্বরূপ যে কোরআন নাজিল করেছেন তার বিধান মেনে চলবে তারাই সফল। এছাড়া মুসলমানদের পরিশুদ্ধ জীবন-যাপনের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন তিনি। সব কাজে ইসলামের বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

খুতবার পর মসজিদে নামিরায় সমবেত মুসলমানরা এক আজান এবং দুই ইকামতে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে জামাতে আদায় করবেন। কারোর অবস্থান দূরে থাকলে তিনি নিজের তাঁবুতে আলাদাভাবে আদায় করবেন জোহর এবং আসরের নামাজ।
সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু সময় পর হজযাত্রীরা মাগরিবের নামাজ আদায় না করেই আরাফাত ময়দান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেন। মুজদালিফায় গিয়ে এশার নামাজের সময় একসঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের পর সেখানেই খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে রাত যাপন করবেন। এর আগে প্রতীকী শয়তানের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপের জন্য তারা সেখান থেকে পাথর সংগ্রহ করবেন। এর পরের দিন হজযাত্রীরা ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় অবশ্যই মুজদালিফায় অবস্থান করবেন। এরপর তারা যাবেন মিনায়।

মিনার জামারায় (শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর ছোঁড়ার স্থান) বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে প্রতীকী সাতটি পাথর নিক্ষেপ শেষে পশু কোরবানি এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) আদর্শ অনুসরণে পুরুষরা মাথা মু-নের পর গোসল করবেন। নারীরা চুলের অগ্রভাগ থেকে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কাটবেন। এরপর হাজিরা সেলাইবিহীন ইহরাম খুলবেন। এরপর হাজিরা মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে সুবেহ সাদিকের পর থেকে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। কাবা শরিফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় সাতবার ‘সাই’ (দৌড়ানো) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার ফিরে যাবেন মিনায়, নিজেদের তাঁবুতে।

হজযাত্রীরা ১১ জিলহজ আবার জামারায় গিয়ে জোহরের নামাজের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। একইভাবে ১২ জিলহজ আবারও ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপের পর সন্ধ্যার আগে তারা মিনা ত্যাগ করবেন। ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে কাবা শরিফে ফরজ তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা।

৯৩ হাজার হজ¦যাত্রীকে স্বাস্থ্যসেবা দিলো সৌদী
১৫ জুন,আরব নিউজ : তীব্র গরমের মধ্যেই এবারের হজ পালিত হচ্ছে। এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন লাখো হাজি। তাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে প্রতিবারের মতো এবারও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি প্রশাসন। শুক্রবার (১৪ জুন) পর্যন্ত ৯৩ হাজার হাজিদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে দেশটি। সৌদি সংবাদমাধ্যম এই খবর জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১৯টি ওপেন-হার্ট সার্জারি, ২১৮টি কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন এবং ৬৭৬টি ডায়ালাইসিস করা হয়েছে।

এছাড়া, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে আরও ২ হাজার ২০ জনেরও বেশি হাজিকে।
হাজিদের সেবায় ৩৪ হাজারের বেশি চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট ও প্রশাসনিক কর্মী নিয়োগ দিয়েছে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, ১৮৯টি হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এমনকি মোবাইল ক্লিনিকে তাদের পরিবহনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৭৩০টি অ্যাম্বুলেন্স ও সাতটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালযের তথ্য মতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭০ হাজারের বেশি হজ¦যাত্রী এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সেবা গ্রহণ করেছেন।
গরম থেকে হাজিদের বাঁচাতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করলো সৌদী

গ্রীষ্মের তীব্র গরম থেকে হজযাত্রীদের রক্ষা করতে রোড-কুলিং টেকনোলজি ব্যবহার করেছে সৌদি আরব। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে রাস্তাগুলোর তাপ শোষণ ও নির্গমন ক্ষমতা হ্রাস হয়। ফলে রাস্তা তুলনামূলক অনেকটাই শীতল থাকে। হাজিদের জন্য হজের অভিজ্ঞতাকে আরও নিরাপদ ও আরামদায়ক করতে উদ্ভাবনী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে দেশটি। এই তথ্য জানিয়েছে সৌদি রোডস জেনারেল অথরিটির এক মুখপাত্র আবদুল আজিজ আল-ওতাইবি। শুক্রবার আরব নিউজ এই খবর জানিয়েছে।
আবদুল আজিজ আরব নিউজকে বলেছেন, ‘সূর্যালোকের সংস্পর্শে সড়ক মূলত তাপ শোষণ করে থাকে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোষণ করা এই তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়।’

এর ফলে সড়ক তাপ নির্গমন শুরু করে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পবিত্র স্থানগুলোর চারপাশের ফুটপাতে ব্যবহারের জন্য তারা এমন একটি শীতল উপাদান তৈরি করেছে, যেটি ঐতিহ্যগত পদার্থের তুলনায় কম তাপ শোষণ এবং নির্গমন করে।

এ বিষয়ে আবদুল আজিজ বলেছেন, ‘আমরা যে উপাদানটি তৈরি করেছি তা রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কেননা, এটি সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করে, যা তাপ শোষণের মাত্রা কমিয়ে সড়কের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।’
এতে রাস্তা ঠা-া থাকে, যা পথচারীদের জন্য হজযাত্রা আরও আনন্দদায়ক করে তোলে।

বিশ্বের লাখ লাখ হজ¦যাত্রীর জন্য অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়নে সৌদি আরবের চলমান প্রচেষ্টার একটি অংশ এই রোড-কুলিং টেকনোলজি।

আবদুল আজিজ আরও জানান, ‘ডাটা দেখা গেছে, শীতল এই উপাদানটি রাস্তার উপরিভাগের তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমাতে সাহায্য করেছে।’

গত হজ মৌসুমে জামারাত করিডোরে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে রোড কুলিং টেকনোলজি প্রয়োগ করে সফল হয়েছিলেন তারা। তাই এবার মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা এলাকার রাস্তায় এই প্রকল্প সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আরাফাতের নামিরা মসজিদের কাছে ২৫ হাজার বর্গমিটার রাস্তাতেও এই উপাদানটি প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবদুল আজিজ।

https://www.dailysangram.info/post/558925