১২ জুন ২০২৪, বুধবার, ৬:০৯

দুঃসময়ে গ্রামীণ অর্থনীতি

এক বছরে আমানত কমেছে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা বা ২১ শতাংশ

পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ তার আয়ের সাথে ব্যয় সমন্বয় করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে জমানো অর্থ তুলে খরচ করছেন। এ কারণে গত এক বছরে শুধু ব্যাংকিং খাতে গ্রামের মানুষের আমানত কমেছে প্রায় পৌনে এক লাখ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ২১ ভাগ। শুধু আমানতই কমছে না, ঋণও কমে যাচ্ছে। গত এক বছরে গ্রামে বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ২৬ শতাংশ। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, আমানত কমে যাওয়ার পাশাপাশি ঋণ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে গ্রামে কাজ না পেয়ে মানুষ ছুটে আসছে শহরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, টানা এক বছর যাবৎ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যেমন গত বছরের জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, আর গত মেতে তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত মাসে বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, আগের মাস (এপ্রিলে) যেখানে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, গ্রামের মানুষের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় হয় খাদ্যে। তাই খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে গ্রামীণ মানুষের দুর্ভোগ হয় বেশি হারে। মানুষের যখন ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়, তখন বর্ধিত অংশ সঞ্চয় করে থাকে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এখন আর সঞ্চয় করতে পারছে না, খরচ কুলাতে না পেরে জমানো অর্থ ভেঙে ফেলছে। আর এরই প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ প্রান্তিকে গ্রামে ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে আমানত কমে হয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে গ্রামে আমানত কমেছে ৭২ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ২১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রামে এক বছরে ৭২ হাজার কোটি টাকা কমে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কারণ দেশের রেমিট্যান্সের বড় সুবিধাভোগী হলো গ্রামীণ জনপদ।

দেশের রেমিট্যান্সের বড় অবদান হলো গ্রামের মানুষের। রেমিট্যান্সের যে অর্থ দেশে আসে তা সরাসরি ব্যাংকে চলে যায়। এ কারণে গ্রামে আমানত বেশি বাড়ার কথা। সেখানে আমানত না বেড়ে বরং কমে যাওয়ার অর্থই হলো গ্রামীণ অর্থনীতি সঠিক অবস্থানে নেই। শুধু আমানতই কমছে না, বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে সমানতালে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ প্রান্তিকে গ্রামে ব্যাংকগুলোর ঋণ ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে গ্রামে ব্যাংকগুলোর ঋণ কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ২৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির বড় অবদান রাখে গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ থেকে। শ্রমঘন শিল্পের কারণে কর্মসংস্থান বাড়ে। আর কর্মসংস্থান বাড়লে বেড়ে যায় ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু আমানত কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনিয়োগও কমে গেছে। আর বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অর্থ হলো গ্রামের কর্মস্থান সঙ্কোচিত হয়ে পড়ছে। আর এ কারণে গ্রামে কাজ না পেয়ে মানুষ শহরে ছুটছে। এতে শহরের চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অন্যান্য সেবার ব্যয় বেড়েছে। গ্যাস থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণ এবং পশু, পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্যের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে জীবনযাত্রা, কৃষিসহ সবদিকেই ব্যয় বেড়েছে। এতে মানুষকে সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। এতে গ্রামে ব্যাংকগুলোর আমানত কমে যাচ্ছে।

গ্রামীণ শাখাগুলোয় আমানত কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, রেমিট্যান্সসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোয় আমানত কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে এলে সেটির একটি অংশ ব্যাংকের শাখাগুলোয় আমানত হিসেবে জমা হয়। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে এলে সে অর্থ ব্যাংকে ফিরতে অনেক সময় লাগে। পাশাপাশি উচ্চ মুল্যস্ফীতির চাপেও মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি মন্থর। এ কারণে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সঙ্কটও সৃষ্টি হয়েছে। কিছু ব্যাংক এখন ১৩-১৪ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিচ্ছে। এর পরও প্রত্যাশিত আমানত মিলছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংকে সঞ্চয়ের মতো অর্থ বেশির ভাগ মানুষের হাতেই অবশিষ্ট থাকছে না।

গ্রামের মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সঞ্চয় ভাঙছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংকের স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপকরাও। তারা জানিয়েছেন, মূলত জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তরা আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে চলতে পারছে না। যে কারণে তারা ডিপিএস ভেঙে ফেলছে। এতে আমাদের আমানতও কমে আসছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/842141