৪ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার, ৬:৪১

পাহাড়ি জনপদেও বেনজীরের থাবা!

বান্দরবানে ১০০ বিঘার খামার বাড়ি

দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পত্তির যেন শেষ নেই! তিন দফায় আদালতের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর বিপুল সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার পরও নতুন করে আরও অনেক সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। গাজীপুর ও গোপালগঞ্জে অভিজাত রিসোর্টের পর এবার পাহাড়াঞ্চল বান্দরবানে পাওয়া গেছে তার শত বিঘার খামারবাড়ি। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন বাংলো বাড়ি, মৎস্য ও পশু খামার। অভিযোগ আছে, এই খামারের জমি কিনতে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে ভূমি মালিকদের। কম দামে জমি বিক্রি করতে রাজি না হলে হয়রানি করা হয়েছে পাহাড়ি জনপদের দরিদ্র বাসিন্দাদের। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

জানা গেছে, বান্দরবানে দুটি উপজেলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে রয়েছে প্রায় একশ একর পাহাড়ি জমি।

সদরের সুয়ালক এলাকায় রয়েছে পঁচিশ একরের জমিতে মৎস্য ও গরুর খামার, অবকাশযাপনে বাংলো তৈরি করা হয়েছে। লামার ডলুছড়িতে রয়েছে পঞ্চান্ন একরের জমিতে ফলজ-বনজ বাগান ও বাংলো
বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে জায়গাগুলো পুলিশ ‘আইজিপির খামারবাড়ি’ হিসাবে পরিচিত।

অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায় গরিব মানুষজনদের নামমাত্র মূল্যে জমিগুলো বিক্রি করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। জমিগুলো নামমাত্র দামে কিনে দখল করে নিতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা এবং দুটি মৌজার হেডম্যান। পর্দার আড়াল থেকে জমিতে যাওয়ার সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা। মূলত তার মদদে পাহাড়ি ভূমিগুলো খুব সহজে বেনজীর আহমেদ নিজের এবং স্ত্রী ও মেয়ের নামে কাগজ করে নিতে পেরেছেন।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, ২০১৬ সালে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগে ও ৩ নম্বর শিটে ২৫ একর জায়গা লিজের ভিত্তিতে নেন বান্দরবান পৌরসভার বাসিন্দা আবুল কাশেমের পুত্র শাহজাহানের কাছ থেকে।

সরেজমিন দেখা গেছে, লিজ নেওয়া পঁচিশ একর জায়গাজুড়ে মৎস্য ও গরুর খামার এবং পাহাড়ে অবকাশযাপনের জন্য দোতলা একটি বাংলো বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। খামারে বিক্রিযোগ্য ৩৫টি গরুও রয়েছে। সবচেয়ে বড় গরুটির দাম আড়াই লাখ টাকা বলেও জানিয়েছেন খামারের কর্মচারী। খামারে যেতে সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা এবং বিদ্যুৎ সংযোগও। অবকাশযাপনে তৈরি করা দোতলা বাংলোয় রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।

কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা খামারের চার পাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জাতের ফলজ এবং বনজ গাছ। বাগানের প্রবেশমুখে তালাবদ্ধ আকর্ষণীয় গেট। এছাড়া লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর পরিবারের নামে রয়েছে ৫৫ একর পাহাড়ি জমি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন ধরনের মিশ্র ফলের ও বনজ গাছের বাগান।
সেখানেও তৈরি করেছেন একটি বাংলো। পাহাড়ের গোটা জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াতে লেগে যায় পুরোটা দিন।

স্থানীয়রা জানান, বেনজীরের খামারে দায়িত্বে নিয়োজিত নজুম উদ্দিন, লেদু মিয়া বলেন, খামারসহ এই জায়গাটির সবকিছু দেখাশোনা করেন মূলত মং ওয়াইচিং দাদা। তিনি বান্দরবান জেলা সদরের মধ্যমপাড়াতে থাকেন।

অভিযোগ আছে, ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনজীর আহমদ নামমাত্র দামে ৫৫ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এসময় পাহাড়ের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। অসহায় পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ও আয়ের উৎস ছিল পাহাড়ের জমিগুলো।

গাজীপুরে বন দখল করে রিসোর্ট : স্টাফ রিপোর্টার গাজীপুর জানান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীরের দাপটে সরকারি বনে ভাওয়াল রিসোর্ট শাল গজারিঘেরা বনের ভেতর বিলাসবহুল ভাওয়াল রিসোর্ট স্পা। সরকারি বন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতারকা মানের এই রিসোর্ট। এছাড়া ভয় দেখিয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জে কিনেছেন নামে-বেনামে শতবিঘা জমি।

অভিযোগ রয়েছে, গাজীপুরের বারুইপাড়া মৌজার নলজানি এলাকায় কৌশলে বনের ভেতরে প্রথমে ব্যক্তিমালিকানায় কিছু জমি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে বেনজীর আহমেদের অদৃশ্য ক্ষমতায় আশপাশের ৬ একর ৭০ শতাংশ বনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন ভাওয়াল রিসোর্ট এন্ড স্পা। এর ২৫ শতাংশের মালিক বেনজীর আহমেদ।

একই সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করে দখল করে নেন প্রায় ৩ একর কৃষিজমি। বিলাসবহুল রিসোর্টটির দখল বাণিজ্যে মাথা হিসাবে থেকেই ২৫ শতাংশ শেয়ার পেয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ। ভুক্তভোগী শফিউল্লাহ বলেন, রিসোর্টের মূল ফটকের সামনে বানানো পাহাড় ও ভেতরের জমি তাদের ছিল। মূল্য পরিশোধ না করেই জমিটি বেদখল করে নেওয়া হয়েছে। বেনজীর আহমেদের সাহসেই রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ এসব করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, দখলদারদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে দিনের পর দিন নীরব থেকেছে এখানকার স্থানীয় বন বিভাগের কর্তারা। তবে দুদক ও আদালতের তৎপরতায় যেন নড়েচড়ে বসতে চাইছে জেলা প্রশাসন। অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দ্রুতই বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।

এদিকে,অবৈধ দখলের অভিযোগ এনে গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্টের মালিক শওকত রাসেলসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত রোববার আদালতে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক মুক্তিযোদ্ধা।

অপরদিকে, কালীগঞ্জ উপজেলায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে শতবিঘা জমি রয়েছে। ইতোমধ্যে দুদক এসব জমির সন্ধান পেয়েছেন।

গাজীপুরে বেনজীর পরিবার জমি কেনা শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। তখন র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। অনেককে ভয় দেখিয়ে নামমাত্র দাম দিয়ে জমি লিখে নিয়েছেন। এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস কারও ছিল না। তবে এসব বেশির ভাগ জমি তিনি ২০২২ সালের দিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব জমি কিনেছেন ১০ ব্যক্তি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/812605