৪ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার, ৬:২৩

উৎপাদন ছাড়াই জাতির কাঁধে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের দায়!

দেশের বিদ্যুৎ খাত কি দিনে দিনে বোঝায় পরিণত হচ্ছে? বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, উৎপাদন ছাড়াই জাতির ঘাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের দায় চেপে রয়েছে। এই ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলো বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, এই ক্যাপাসিটির কেন্দ্রগুলো আগামী দিনের চাহিদা পূরণ করবে।

প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক দেশের সরকারি ও বেসরকারি ১৫০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্তমান স্থাপিত ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুতের প্রকৃত গড় চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বাকি ১২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর পেছনে কোনো উৎপাদন ছাড়াই বিপুল অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এরমধ্যেও আবার নতুন বিদ্যুতকেন্দ্রের পরিকল্পনা হচ্ছে, আমদানি করার প্রবণতা থাকছে, লোডশেডিংও থাকছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো সম্ভব হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথাও বলা হচ্ছে। সবমিলিয়ে এক পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতি অব্যাহত আছে বিদ্যুতসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে।

ক্ষমতা বনাম চাহিদা
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)’র প্রদর্শিত হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর ৩০ মে পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বমোট চাহিদা ১৪,০৯৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের চাহিদা ৫,১৭৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম বিভাগ ১,৪০৮, খুলনা ১,৭৩৪, রাজশাহী ১,৬১৪, কুমিল্লা ১,৩০৫, ময়মনসিংহ ১,১৯৫, সিলেট ৪২৫, বরিশাল ২৩৪ এবং রংপুর বিভাগে ১,০০৭ মেগাওয়াট। একই তারিখে বিপিডিবি’র প্রদর্শিত হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে কয়লা থেকে ৬ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট, গ্যাস থেকে ১২ হাজার ২১৬ মেগাওয়াট, জ¦ালানি তেল (এইচএফও) থেকে ৬ হাজার ০৩৫ মেগাওয়াট, হাইস্পিড ডিজেল (এইচএসডি) ২৯০ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ (হাইড্রো) ২৩০ মেগাওয়াট, আমদানিকৃত ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট, সোলার সিস্টেম থেকে ৪৫৯ মেগাওয়াট এবং বায়ু চালিত ৬০ মেগাওয়াট। গত ৩০ মে প্রদর্শিত (ফোরকাস্ট) অনুযায়ী সর্বাধিক চাহিদা দেখানো হয় ১৫ হাজার মেগাওয়াট, সর্বাধিক উৎপাদন ১৫ হাজার ৮৯৭ মেগাওয়াট এবং সংরক্ষিত ৮৯৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এবছর ৬ মার্চ তারিখের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মাসে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১৫ হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের সুবিধাপ্রাপ্তি দেখানো হয় শতকরা ১০০ ভাগ।

চাহিদা মেটাচ্ছে সরকারি খাত? : বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হিসাব করে দেখা যায়, দেশে বিদ্যুতের যে নিয়মিত চাহিদা তা মোটামুটিভাবে সরকারি খাতই মেটাতে পারছে। কিছু যৌথ কেন্দ্র ও বেসরকারি খাত থেকে মেটানো যায়। আর আমদানিকৃত বিদ্যুৎ কিছু ঘাটতি পূরণ করে। তবে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এই আমদানির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মালিকানা অনুয়ায়ী গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার হিসাবে দেখা যায়, মোট ১৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬০টি, স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাতের কেন্দ্র সংখ্যা ৮৮টি, স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট। যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র ২টি, ক্ষমতা ১ হাজার ৮৬১ মেগাওয়াট। আমদানি করা হয় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট।

ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা : বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা টানতে হচ্ছে প্রতিবছর। এভাবে কেন্দ্রগুলোর মালিকদের পাওনা দুই বছর ধরে পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। প্রাপ্ত তথ্যে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়ার কথা জানা গেছে। এর ফলে বছরে লোকসান ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।
এ পটভূমিতে সরকার বন্ড ইস্যু করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসবই হচ্ছে চাহিদার চেয়ে বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। বাড়তি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। গত অর্থবছরে ১৭ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের হাতে। তবু নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, পুরোনো কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ছে। নতুন আরো প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।

অপর এক তথ্যে জানা যায়, ৪২টি সরকারি এবং ২৬টি বেসরকারি অর্থাৎ মোট ৬৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গত ৫ অর্থবছরে তাদের উৎপাদনসক্ষমতার ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। কিন্তু উৎপাদন না করেও উৎপাদনের পূর্ণ ক্ষমতার জন্য তারা সরকারের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে ক্যাপাসিটি চার্জ গ্রহণ করেছে। এককথায় বলা যায়, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও বা চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ফলে এগুলোর অধিকাংশ উৎপাদন না করে বন্ধ থাকছে। উৎপাদন না থাকায় এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার জন্য বিপুল অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে। সে কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতির প্রধান কারণ হলো ক্যাপাসিটি চার্জ।

বোঝার দায় জনগণের কাঁধে : বলা হচ্ছে, পিডিবি প্রতিবছর উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বাজেট অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ বা ব্যবহার না করে প্রদেয় ভাড়া হিসেবে আনুমানিক ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রদান করা হয়েছে। এটা মোট ভর্তুকির ৮১%। এককথায়, পিডিবির ক্ষতি কমানোর জন্য যে ভর্তুকির অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, তার ৮১% খরচ হয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া বাবদ অর্থ প্রদানে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পিডিবির লোকসানের অধিকাংশই বেসরকারি ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ খাতে তাদের চুক্তি অনুযায়ী মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের কারণে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের অর্থে ভর্তুকির প্রয়োজন হয়েছিল পিডিবির লোকসান কমানোর জন্য। বাস্তবে ক্ষতির প্রধান কারণ অলস বসিয়ে রাখা বেসরকারি ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার অর্থ প্রদান। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের ঘাড়ে সরাসরি বোঝা চাপিয়ে ভর্তুকির অংক কমানো হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বাড়তি দামের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশ ওই একই খাতে ভাড়া হিসেবে বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রদান করা হচ্ছে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে এ থেকে আয় না হওয়া সত্ত্বেও যে ক্যাপাসিটি চার্জ বা তার খরচ দেয়া হচ্ছে, সেটিই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র না থাকলে বা সংখ্যায় কম হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না বা এতো বেশি পর্যায়ে বৃদ্ধি দরকার হতো না।

https://www.dailysangram.info/post/557975