১ জুন ২০২৪, শনিবার, ৫:০০

ঈদকে টার্গেট করে খোলস বদলাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ বাস

গত ঈদে ফরিদপুরে বাস-পিকআপের সংঘর্ষে ১৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর জানা যায়, বাসটি ফিটনেস ছাড়পত্র ছাড়াই চলাচল করছে। ছিল না রোড পারমিটও। ঢাকাসহ সারা দেশের অধিকাংশ গণপরিবহনের চিত্রই এটি। আয়ুষ্কাল ও ফিটনেস ছাড়পত্র না থাকলেও দেদারছে সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যানবাহন। শুধু ঢাকায় নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের মধ্যে আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে ২৮ শতাংশের। এসব যানবাহনে কেবল বডিতে রং করে চাকচিক্য রূপ দিয়ে সড়কে চলছে। খোলস বদল করা ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল করায় সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ৫২ হাজার ১৫৪টি। এরমধ্যে ২৮ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৬১০টি বাস-মিনিবাসের ইকোনমিক লাইফ (আয়ুষ্কাল) শেষ। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরের বাইরে আরও ২১ হাজার ১৭২টি বাস-মিনিবাসের ইকোনমিক লাইফ ফুরিয়েছে।

এদিকে গত মাসে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, ২৪ শতাংশ বাসের কোনো ফিটনেস সনদ নেই।

বাসের চালক ও সহকারীরা জানান, বাসের মালিকরা নিয়মিত বাস ফিটফাট রাখেন না। তাই ঢাকার লোকাল বাসগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ। কোনো কোনো বাসে পর্যাপ্ত লুকিং গ্লাসও থাকে না। তাছাড়া জানালার গ্লাসও ভাঙা থাকে। আবার বাসের ভেতর নষ্ট ফ্যান ও ভাঙা সিটে যাত্রীদের অসুবিধা হয়। এসব বিষয়ই ঠিক করতে আগ্রহ দেখান না বাস মালিকরা। তুরাগ পরিবহনের চালকের সহকারী রবিন বলেন, বাস ঠিক করার দায়িত্ব মালিকের। শিকড় পরিবহনের চালক শফিক বলেন, গাড়ি বন্ধ না হইলে চলতেই থাকে। মাঝেমধ্যে রঙ করলেও তা থাকে না। ঘষায় ঘষায় উঠে যায়। মালিক আর কতবার রং করবো।

বাসের জরাজীর্ণতা, রঙচটা, ফিটনেস ইস্যুতে চলতি বছরই একাধিবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত ১৬ই মে সর্বশেষ এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বিআরটিএ জানায়, ঢাকাসহ মহাসড়কে লক্কড়ঝক্কর, রঙচটা, গ্লাস ভাঙা, লাইট ভাঙা, সিট ভাঙা মোটরযান মহাসড়কে চলাচলের কারণে প্রায়শ: সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। জুন মাসের মধ্যে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ মোটরযানকে ত্রুটিমুক্ত ও দৃষ্টিনন্দন করার জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, আগামী ১লা জুলাই থেকে ত্রুটিপূর্ণ মোটরযানের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন এবং বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে এর আগে চলতি মাস পর্যন্ত সময় দিয়ে একই বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে বিআরটিএ। এরপর বাস মালিকদের অনুরোধে ফের এক মাস বাড়ানো হয় সময়। বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, বাস মালিকরা শেষবারের মতো সময় চেয়েছে জরাজীর্ণ, রঙচটা ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ঠিক করতে। তাই আগামী জুন মাস পর্যন্ত ফের তাদের সময় দেয়া হয়েছে। তবে এরপর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলেও জানান তারা। বরাবরের মতো আর্থিক জরিমানায় সুফল না মেলায় মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন বন্ধও করা হতে পারে।

বাস মালিকদের সংগঠনের নেতারা বলছেন, সড়কে জরাজীর্ণ ও ফিটনেস ছাড়া বাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাস মালিকদের বলা হচ্ছে। তারপরও যদি কেউ সেটা না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ ব্যবস্থা নিবে এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা মানবজমিনকে বলেন, যেসব গাড়ির ফিটনেস নেই সেগুলো রাস্তায় চালানো উচিত নয়। যেসব মালিকরা লক্কড়ঝক্কর গাড়ি চালাবে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম খোকন মানবজমিনকে বলেন, প্রত্যেক কোম্পানিকে আমরা চিঠি দিয়ে দিয়েছি। তা না হলে তারা শাস্তির আওতায় আসবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, একযুগ ধরে বিআরটিএ এমন নির্দেশনা দিয়ে আসছে। কিন্তু এসব মানতে বাস মালিকরা আগ্রহ প্রকাশ করছে না। এখন ম্যানেজ করে চলার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। বাস মালিকরা জানে ফিটনেস সনদ ছাড়াও সড়কে চলাচল করা যায়। ঢাকাসহ সারা দেশে যে বাস চলছে তার ৫০ শতাংশের বেশি বাসের আয়ুষ্কাল শেষ। এই যানবাহন সড়ক থেকে সরিয়ে নিতে হবে। তারপর যেসব বাসে আয়ুষ্কাল আছে সেগুলো ঠিকঠাক করে ফিটনেস সনদ নিতে পারে। সেটা না করে লক্কড়ঝক্কর বাসগুলো শুধু রং করে আর কোনো রকম মেরামত করে সনদ নেয়া হলে সেটা বিজ্ঞানসম্মত হবে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, অনেক যানবাহনের ফিটনেস নেই দীর্ঘদিন ধরে। সরকার ২০১৫ সাল থেকেই বার বার ২০ বছরের পুরনো যানবাহন উচ্ছেদের কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগেই অনেক যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ পার হয়েছে। বাস উচ্ছেদ কঠিন বিষয়। সরকার এতে অসহায় হয়ে যায়। তাছাড়া দেশে সিংহভাগ বাসেরই ফিটনেস নেই। যারা ফিটনেস সনদ দেয় তাদের আরও বেশি সরব হওয়া প্রয়োজন।

https://mzamin.com/news.php?news=112398