৩১ মে ২০২৪, শুক্রবার, ১২:১২

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে নেতিবাচক প্রভাব

দু’দশকে উপকূলীয় এলাকার দেড় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দিন দিন অস্বাভাবিকভাবে যে গতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে তাতে অচিরেই বাংলাদেশ ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়বে। সর্বশেষ বাংলাদেশের উপকুলে আঘাতহানে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। রেমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পৌনে দুই লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার পরিবেশের এই বিপর্যয়কে অশনি সংকেত হিসাবে দেখছে পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। উপকূলীয় এলাকার মানুষের যাপিত জীবন ও অর্থনৈতিক খাতগুলো এবং উপকূলীয় মানুষ পেশা পরিবর্তন করছে, আবার অনেকেই শহরমুখী হচ্ছে। দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় দু’শত বছরে ৪৭৮টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, উপকূলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভয়াবহ সংকটে রয়েছে ৪ মিলিয়ন উপকূলবাসীর জীবন ও জীবিকা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে আগামী দু’দশকের মধ্যে দেশের উপকূলীয় এলাকার দেড় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত তিন বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত দেশের এই উপকূলীয় অঞ্চল। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশনপ্ল্যান এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬০-২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৮টি ছোট-বড় সাইক্লোনের ঘটনার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রেমাল সম্পর্কে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা এখনই অবশ্য এত সহজ নয়। কারণ জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও গাছপালার যে ক্ষতি হয় তা নিরূপণ করা সময়সাপেক্ষ। তবে এই মুহূর্তে অবকাঠামোগত যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময়। এতো দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানি থাকায় বন্য প্রাণীদের ক্ষতি হয়েছে। মারা গেছে ৪০টি হরিণ এবং ১টি বন্য শুকর। সাগরের নোনা পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বন্য প্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠা পানির পুকুর-সহ শতাধিক জলাশয়। জীবিত উদ্ধারের পর ১৭টি হরিণকে অবমুক্ত করা হয়। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা জানান, এই এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ গোলপাতার বাগান প্লাবিত হয়ে গেছে। ১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। একটি পল্টুন ভেসে গেছে। এতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই পশ্চিম বিভাগে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসা আটটি হরিণকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে দুটি হরিণ মারা গেছে। বাকি ছয়টিকে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে। খুলনার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অঙ্কে হিসাব করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা। একই সাথে যে পরিমাণ ভূমি ক্ষয় হয়েছে তাও এখনই বোঝা যাবে না বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বনের গাছে শত শত পাখির বাসা ছিল, ডিম-বাচ্চা ছিল। এখন গাছে কোনও পাখি নেই। হরিণ মারা গেছে, গাছ নষ্ট হয়েছে, টাকা দিয়ে এসব মাপা যায় না। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের পাশে মান্দারবাড়িয়া এবং হলদিবুনিয়া নামে দুটি অভয়ারণ্য রয়েছে, যেগুলি পশ্চিম অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এসব অভয়ারণ্যের বন্য প্রাণীদের জন্য তৈরি করা মিঠা পানির পুকুর ভেসে গেছে, জেটি ভেঙ্গে গেছে। তবে, এখনও সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি বলে জানান কর্মকর্তারা।
রেমালে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ঘূর্ণিঝড় রেমালে উপকূলীয় এলাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করেছে। উপকূলীয় ১৯টি জেলা রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। গত বুধবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত দেওয়া এ হিসাবে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর ১৯টি জেলার ১১৯টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় রেমাল তার যে তা-ব চালিয়েছে তা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির সরকারি যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে তাতে। উপকূলীয় এসব উপজেলার ৯৩৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রেমালের দুই দিনের তা-বে পৌনে দুই লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি বাড়িঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি। খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্লাবিত হয়ে গেছে চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের পোনার খামার। এর ফলে শুধু খুলনা বিভাগেই প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানকার বিভাগীয় কার্যালয়। আর বাগেরহাটের চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘের পানিতে ভেসে গেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা বলছেন, পানিতে ঘের প্লাবিত হওয়ায় ভেসে গেছে সব মাছ। ফলে তাদের পুঁজির সব টাকাই নষ্ট হয়েছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। ঝড়ের কারণে বিপর্যয় এড়াতে অনেক এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার ঝড় আঘাত হানার পর বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল উপকূলীয় জেলাগুলোর তিন কোটি তিন লাখ মানুষ।

বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামত করে গত মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আশি শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা গেছে। এরই মধ্যে বুধবার বিকেল নাগাদ প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব বলে জানানো হয়েছে। এদিকে, পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার তুষার কান্তি ম-ল গণমাধ্যমকে বলেন, পটুয়াখালী ও বরগুনার ১২টি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের মোট ছয় লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক। দুপুর পর্যন্ত চার লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনা গেছে। বাকিদেরও দ্রুত সংযোগ দিতে কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় সাড়ে চারশো বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা, জানান ম-ল।

বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে দুর্যোগ ফোরাম। এই সংগঠনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাইম ওয়ারা গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ বাতাসকে ভয় পায় না, ভয় পায় পানিকে। আর জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড় হলে তা বিশাল রূপ নেয়। ৭০ এবং ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সেটাই হয়েছিল। তবে তিনি মনে করেন, ক্ষয়ক্ষতির চিত্রটি সবসময় পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসে না। কারণ তখন তথ্য সংরক্ষণের ততটা ব্যবস্থা ছিলনা। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ ডেডবডি কাউন্ট করে, সরকার ডেডবডি না পেলে মৃত হিসেবে লিপিবদ্ধ করে না। সাগরে যারা হারিয়ে গেছে তাদের হিসাব তো করা হয় না। সিডরে ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলে বলে রেডক্রস। কিন্তু সরকার বলেছিল ৬ হাজার। সুতরাং ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সবসময় ঠিকভাবে উঠে আসেনা। তিনি বলেন, আইলাতে কম মানুষ মারা গিয়েছিল, দিনের বেলায় হওয়াতে অনেকে সরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু আইলার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। শুধু মানুষ না পশু-প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।

জীবন-জীবিকার ঝুঁকির বিষয়ে গবেষণা পরিসংখ্যান: বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামীতে সিডরের মতো দুর্যোগ আরো শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে। জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এদিকে দেশের ২৫ শতাংশ জনগণ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদানও এই অঞ্চলেরই। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ও কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হিমালয়ের অস্বাভাবিক বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, অনাকাক্সিক্ষত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার-পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯ বার, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত ৪০ বছরে ১৪৯টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে স্বয়ং সুন্দরবনও পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সব সময়ই। এই অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ (কপ-২৮)-এর এবারের আসর গত ৩০ নবেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে উদ্বোধন করা হয়।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৭.৫ শতাংশ ভূখ- পানিতে তলিয়ে যাবে, ফলে উপকূলীয় এলাকার ৯৬ ভাগ মানুষ অভিবাসী হবে। দেশের উপকূলবর্তী ১৩ জেলার ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের জিডিপি ১৪.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল, বা আইপিসিসি তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা আগামী ৩০ বছরে ৭ গুণ বেড়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘অ্যাকশন এইড’ এবং ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া’ তাদের এক যৌথ জরিপ প্রতিবেদন, গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল, বা আইপিসিসি, বিশ্বব্যাংক সূত্রে এইসব তথ্য জানাযায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থায়ী ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা: বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশনপ্ল্যান-এ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কি না, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ক্ষতিগুলো হবে বলে আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা, বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ৬ মিলিয়ন মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে, আর ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা হবে ১৩.৬ মিলিয়ন এবং ২০৮০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা হবে ১৪. ৮০ মিলিয়ন, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা ও মরুকরণ, সুপেয় পানির অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, অতিবৃষ্টি ও তীব্র বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিধ্বস ও ভূমিকম্প বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে ২০৮০ সাল নাগাদ ৫১ থেকে ৯৭ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচূত্য হবে, সমুদ্রস্তরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩৩ মিলিয়ন মানুষ ও ২০৮০ সাল নাগাদ ৪৩ মিলিয়ন মানুষ উপকূলীয় এলাকার জমি হারাবে, মৎস্যসম্পদ হ্রাস, জীবজন্তুর অবলুপ্তি বা সংখ্যাগত বিপুল তারতম্য, জীববৈচিত্র ও উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংস, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন হ্রাস বা ধ্বংস, খাদ্যসংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ, অপুষ্টি ও রোগব্যাধি বৃদ্ধি, জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি।

প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ স্থায়ী উদ্বাস্তু হবে এবং সুপেয় পানির সংকট বাড়বে: জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০-এ প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ। দিন দিন বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে, সময়মতো হচ্ছে না বর্ষা বা বন্যা। এ রকম স্বল্প বৃষ্টিপাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে খরায় আক্রান্ত হবে বিপুলসংখ্যক মানুষ, যার মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লোকই বেশি। বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ। এ রকম খরায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার ব্যাপারে বিভিন্ন উৎস থেকে আলাদা আলাদা উপাত্ত পাওয়া যায়। কারো মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ খরায় উদ্বাস্তু হবে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফ্ট-এর তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে। ইউনেস্কো’র প্রতিবেদন মতে, সমুদ্রস্তরের ৪৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে সুন্দরবনের ৭৫% ডুবে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই (২০০৯) সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহীন অরণ্যে, বঙ্গোপসাগর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্পসহ ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার এলাকার ভূমি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে স্থায়ীভাবে। এ সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। যে শিশুরা উদ্বাস্তু হয়ে পরিবারের সঙ্গে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে তাদের জীবনে নেমে আসছে অজানা সমস্যা।

লবণাক্ততার কারণে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছে উপকূলবাসী এই প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ১নং ভুরুলিয়া ইউনিয়নের রফিকুল ইসলাম বলেন, বারবার প্রাকৃতিক দুযোর্গের কারণে উপকূলের প্রতিটি পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবন জীবিকা ঝুঁকিপূর্ণ, অনেকে কর্ম হারিয়ে ছেড়েছেন এলাকা। চিংড়ির ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লবণাক্ততার কারণে ফসলী জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কেউড়া গাছ বাদে অনেক গাছের সংখ্যা দিনিদিন কমে যাচ্ছে। মৌয়ালীদের পেশা ঝুঁকির মুখে কারণ আগের মতো সুন্দর বন থেকে মধু সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। অনেক পরিবারের ভিটেমাটি ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়, কেউবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আইলায় (ঘূর্ণিঝড় আইলা) দূর্গাবাটির বেড়িবাঁধ ভেঙে আমাদের সবকিছু নদীগর্ভে চলে যায়। ২০০৯ সালের পর প্রতিবছরই এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হয়েছে উপকূলের প্রতিটি পরিবার। কেউ ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, কেউবা হারিয়েছেন ফসলের জমি। বাগেরহাটের মংলা উপজেলার অধিবাসী মনিরুজ্জামান বলেন, সুন্দর বন কেন্দ্রীক মানুষের পেশা ঝুকিঁরমুখে। যেমন, মধু, গোলপাতা, কাঠ ও মাছ সংগ্রহকারীরা ১২৫০ টাকা দিয়ে সরকারি পাশ নিয়ে সুন্দরবনে গেলেও তাদের খরচ বাদে তেমন লাভ হয় না। যেকারণে এইসব পেশার অনেক মানুষ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার উপরে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

পরিবেশ গবেষক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু সমস্যাটিকে রোধ করতে হলে গঠনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করতে হবে। যেসমস্ত মানুষ তাদের আবাসস্থল ছেড়ে অনত্র যেতে বাধ্য হচ্ছে তাদেরকে পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূর্ণ করতে হবে। বিপদাপন্ন মানুষদের জন্য বিকল্প জীবিকায়নের ব্যবস্থা ও আয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যাটিকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। শুধু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলেই হবেনা, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব বহন করতে হবে এবং বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে পশ্চিমা বিশ্বের কম জনবসতিপূর্ণ এলাকাতে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। পরিবেশমন্ত্রী গত ১০ ডিসেম্বর রোববার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে কপ-২৮-এ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, প্যারিস চুক্তির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভিযোজন ও প্রশমন এবং অনুদান-ভিত্তিক অর্থায়নের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ৫০:৫০ বরাদ্দের পক্ষে দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের অবস্থান। আমরা নতুন এবং অতিরিক্ত সরকারী অর্থায়নে গুরুত্ব দেব। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে ন্যাপ বাস্তবায়নের জন্য দ্বিগুণ অভিযোজন তহবিল এবং সমর্থনের উপর জোর দেয়, যা ৪৯টি দেশের অগ্রাধিকার যারা ইতিমধ্যে তাদের এনএপি প্রস্তুত করেছে এবং জমা দিয়েছে। আমরা জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের জন্য সময়সীমাবদ্ধ বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্যগুলোর ওপর জোর দিয়ে অভিযোজন সংক্রান্ত গ্লোবাল গোলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উন্মুখ। উল্লেখ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। যেখানে রয়েছে দেশের প্রায় সব হাওর। হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এই অঞ্চল সারা দেশের মৎস্য চাহিদার ২০ ভাগ ও ধানের ১৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধুঁকছে গুরুত্বপূর্ণ এই জনপদ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে হাওর, জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে ৪১৪টি। জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ৬ হাজার ৩০০। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর। ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে রয়েছে ১৩৩টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে চারটি, কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে তিনটি হাওর। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলায় এসব হাওর, জলাভূমি ও জলাশয়ের অধিকাংশের অবস্থান। এসব জেলাধীন এলাকাগুলোকে বলা হয় হাওরাঞ্চল। এর বাইরেও সব জেলায়ই ছোট-বড় বিল, জলাশয়, জলাভূমি রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে যা দেশের এক-পঞ্চমাংশ। এখানকার কৃষি উৎপাদন ও মৎস্যের পরিমাণ জনসংখ্যা অনুপাতে উদ্বৃত্ত।

https://dailysangram.info/post/557607