২৯ মে ২০২৪, বুধবার, ৪:২৫

ঘূর্ণিঝড়ে নতুন মাত্রা রেমাল

তাণ্ডব দীর্ঘ সময়, সাথে ভারী বর্ষণ

দীর্ঘ সময়, ভারী বর্ষণ ও জোয়ারে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রবল গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। এর আগে কোনো ঘূর্ণিঝড়ই উপকূলে ওঠার পর স্থলভাগে এত দীর্ঘ সময় অবস্থান করেনি। তা ছাড়া দেশব্যাপী এত বেশি ভারী বর্ষণ এবং একেবারে নতুন এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশের ইতিহাসও নেই। এ ছাড়া দীর্ঘসময় ধরে পানি আটকে থাকাও নতুন ঘটনা। এককথায় রেমাল মাঝারি মানের একটি ঘূর্ণিঝড় হলেও এটা ধারণ করেছে এক নতুন মাত্রা।

রেমালের প্রভাবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে দেশের সর্বোচ্চ ৩০৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। একই সমেয় ঢাকায় ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১১২ মিলিমিটার। উপকূলীয় এলাকার নয়া দিগন্তের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এবার দীর্ঘ সময় ধরে জোয়ারের পানি উঠেছে উপকূলের ওপরের দিকে অনেক দূর পর্যন্ত। ঝালকাঠির রাজাপুর থানার আবু সায়েম আকন জানান, এর আগে কখনো আমাদের সমতল থেকে উঁচু বাড়িতে জোয়ারের পানি উঠেনি। কিন্তু এবার রেমালের প্রভাবে আমাদের বসত ঘরে পর্যন্ত পানি উঠেছে। আমরা প্রথমে আশ্চর্য হলেও ভেবেছিলাম, বেশি পানি উঠবে না। কারণ আমাদের এখানে জোয়ারের পানি ওঠার ইতিহাস নেই। শেষ পর্যন্ত আমরা ঘরের অনেক কিছুই বাঁচাতে পারিনি। অল্প কিছু বাঁচানোর পরই অনেকের খাট ডুবে গিয়ে বিছানাপত্র ভিজিয়েছে। আবার যারা বাড়িতে ছিলেন না, তাদের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি পানি উঠে ফ্রিজার অকেজো এবং এতে সংরক্ষিত খাবার নষ্ট করে দিয়েছে। তা ছাড়া হঠাৎ পানি ওঠায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আমরা। অবশ্য কেউ কেউ দূর থেকে মোবাইল চার্জ দিয়ে এনে জরুরি যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আবু সায়েম আকন বলেন, আমরা কেন, আমাদের মা-বাবারাও বাড়িতে জোয়ারের পানি দেখেননি।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিশিষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ জুলি এন র‌্যাঙ্গলি গ্লোবার ফিউচার ল্যাবরেটরির সিনিয়র গ্লোবার ফিউচার সায়েন্টিস্ট ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘উপকূলে ওঠার পর ঘূর্ণিঝড় রেমালের গতি কমে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের চিহ্ন প্রদর্শন করে, এটা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে অনেক দীর্ঘ সময় নিয়েছে। এমনটা সম্ভবত বাংলাদেশে এবারই প্রথম এবং এই ধীর গতির ফলে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় এবং একটি নতুন উপাদান যোগ হলো।’

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে ওঠার পর স্থলভাগে অবস্থান করে ৪০ ঘণ্টা। রেমাল ২৬ মে (রোববার) সন্ধ্যার পর উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করলেও রোববার সারারাত লাগে এর উপকূল অতিক্রম করতে। সোমবার সকাল বেলা অনেকক্ষণ যশোরে অবস্থান করে গভীর নি¤œচাপ আকারে। পরে এটা ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে সিলেট ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল স্থল নি¤œচাপ আকারে। সিলেটে অবস্থানের আগে স্থল নি¤œচাপ আকারে মানিকগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকায় গতকাল সকাল ৯টার দিকে অবস্থান করে। এটি আরো উত্তর দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হতে ক্রমে দুর্বল হয়ে যাবে। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ আরো বলেন, এবারে ঘূর্ণিঝড়টি অনেক বেশি সময় নিয়েছে বাংলাদেশ অতিক্রম করতে। এটা ঘূর্ণিঝড়ের একটি নতুন মাত্রা।

ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘ইদানীং উপকূলে এসে ঘূর্ণিঝড় অনেক বেশি সময় নিয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে এবং থেমে থেমে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ধীর গতিতে এবং থেমে থাকার কারণে এর আশপাশে অনেক ভারী বর্ষণ হচ্ছে। শুধু রেমালই নয়, এর আগে ২০২১ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ স্থলভাগে প্রবেশের সময় একই প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। ইয়াশের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে ভারতের কলকাতা বিমান বন্দরের ডুবে যাওয়ার কথা আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু যে রেমাল অথবা ইয়াশের মতো গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের বেলায় এমনটা ঘটেছে তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া হ্যারিকেন ইরমা ও মারিয়ার বেলায়ও এমন ঘটনা ঘটছে।’ এ দিকে আবহাওয়া অধিদফতর গত সোমবার সকাল থেকেই আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন প্রচার বন্ধ করে দেয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক অবস্থান কোথায় তা সাধারণ মানুষ জানতে পারেননি বলে তারা বৃষ্টি অথবা জোয়ারের পানি নিয়ে অজ্ঞতার মধ্যে ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

এ দিকে রেমালের প্রভাব কাটতে না কাটতেই আবারো দেশে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। আজ বুধবার সারা দেশেই ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আজ ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুই-এক জায়গায় দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ঢাকায় বৃষ্টি কমে গেছে। যদিও আকাশ মেঘলা ছিল। সার্বিক তাপমাত্রাও কিছুটা বেড়েছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে রংপুরে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন উঠে বান্দরবান ও টাঙ্গাইলে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৩৪.৪ ও ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/838567