২৮ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ৫:৪৮

সারা দেশে বিদ্যুৎবিহীন ২ কোটি ৭২ লাখ গ্রাহক

বিদ্যুৎ খাতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি ৯৬ কোটি টাকা

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকা, ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের প্রায় ২ কোটি ৬৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)-সহ এ সংখ্যা ২ কোটি ৭২ লাখ। চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে ক্ষতির পরিমাণ ৯৬ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শুধু পল্লী বিদ্যুতের ক্ষতি হয়েছে ৯২ কোটি টাকা। ক্ষতির পরিমাণ এখনো বাড়ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে অনেক এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় গাছ পড়ে লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় উপকূলীয় এলাকাগুলোর অধিকাংশ মোবাইল ফোনের টাওয়ারের ব্যাটারি বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু টাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থায় চালু রাখা হলেও বন্ধ টাওয়ারের সংখ্যা ১০ হাজারের মতো বলে জানিয়েছে টাওয়ার কোম্পানিগুলো। টাওয়ার বন্ধ থাকায় দেশব্যাপী চরমভাবে বিঘ্ন হচ্ছে ইন্টারনেট সেবা। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন গ্রাহকদেরও চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে। তবে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, আজকের মধ্যে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সেবা পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশালের অধিকাংশ গ্রাহক এবং ফেনী, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলার বেশির ভাগ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এলাকাভেদে ১০ থেকে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না এসব এলাকার গ্রাহক। সোমবার ঢাকায় দুপুরের পর অনেক জায়গায় ফিডার ট্রিফ করেও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। এর মধ্যে নিকুঞ্জ, শেখের টেক, মিরপুর, কাউলা, রায়েরবাগ, বাড্ডা, সিপাহীবাগ অন্যতম। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিচালন ও বিতরণ) দেবাশীষ চক্রবর্তী সোমবার যুগান্তরকে জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রায় ২ কোটি ৬৬ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করছি, রাতের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক হবে। পাশাপাশি পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওজোপাডিকোর প্রায় সাড়ে চার লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে, তার ছিঁড়ে এবং সঞ্চালন লাইনে গাছপালা ভেঙে পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ বিভাগের উপপ্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দীনের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভৌগোলিক এলাকায় ঝড়বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬৫টি সমিতিতে গ্রাহক সংযোগ বেশির ভাগ বন্ধ আছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার ৩০টি সমিতিতে রিমালের প্রভাবে পোল বিনষ্ট হয়েছে ২৩৯২টি, ট্রান্সফরমার বিনষ্ট ১৯৮২টি, স্প্যান (তার ছেঁড়া) ৬২৪৫৪টি, ইনসুলেটর ভাঙা ২১৮৪৮টি এবং মিটার বিনষ্ট ৪৬৩১৮টি। সার্বিকভাবে প্রাথমিক এ সমিতিগুলোয় ক্ষয়ক্ষতি ৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বেলা ২টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুসার ৬৫টি সমিতিতে বিদ্যুৎবিহীন গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ওজোপাডিকোর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য : পোল বিনষ্ট ২০টি, পোল হেলে পড়া ১৩৫টি, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়া ২৪.৩৪ কিমি., ১১ কেভি পোল ফিটিংস বিনষ্ট হওয়া ১৪২ সেট, ট্রান্সফরমার বিনষ্ট ১২টি এবং ১১ কেভি ইনসুলেটর বিনষ্ট ১৩৪। সার্বিকভাবে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বেলা ৫টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিদ্যুৎবিহীন গ্রাহক সংখ্যা ৪ লাখ ৫৩ হাজার।

বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমাল-পরবর্তী গভীর সমুদ্রে থাকা এলএনজি টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্থাপনাগুলোর কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পর বর্তমানে এলএনজি সরবরাহ ১০০০ এমএমসিএফডিতে উন্নীত হয়েছে। আজ থেকে এ সরবরাহ আরও বাড়ানো হবে বলে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করে ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে তদারকি করা হচ্ছে। জেলা পর্যায় ও সমিতিভিত্তিক কন্ট্রোল রুম রয়েছে। পরিবহণ ঠিকাদারকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও ওজোপাডিকো এলাকায় সব ধরনের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঝড় বা বাতাস কমার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক করা হবে।

বাগেরহাটে ছয় লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন : রোববার সকাল থেকেই জেলার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার অধিকাংশ এবং আশাশুনি উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় সোমবার সারা দিনই বিদ্যুৎ ছিল না। অন্যান্য এলাকায়ও রোববার থেকে বিদ্যুৎ ছিল আসা-যাওয়ার মধ্যে। জেলা সদরে রোববার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওজোপাডিকো বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছিল। কিন্তু সঞ্চালন লাইনে গাছপালা উপড়ে পড়ায় রাত ১১টার পর বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক সুশান্ত রায় জানান, জেলায় তাদের ৪ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে। সঞ্চালন লাইনের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ফেনীতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন চার লাখ গ্রাহক : ফেনীতে রোববার রাত থেকেই উপজেলাগুলোয় বিদ্যুৎ ছিল আসা-যাওয়ার মধ্যে। জেলা শহরে মধ্যরাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক থাকলেও তারপর থেকে বেশির ভাগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার হাওলাদার মো. ফজলুর রহমান বলেন, রোরবার রাত থেকেই ঝড়ো হাওয়ায় বিদ্যুতের সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে পুরোপুরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বর্তমানে জেলায় পল্লী বিদ্যুতের ৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।’
সাতক্ষীরায় ৬ লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন : সাতক্ষীরা জেলায় ছয় লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

মহেশখালীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ : রোববার রাত দেড়টা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন উপজেলার একটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়নের অন্তত ৭০ হাজার গ্রাহক। কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহেশখালী জোনাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) নাজমুল হাসান বলেন, লাইন স্বাভাবিক করতে সোমবার সকাল থেকে পল্লী বিদ্যুতের ৬০ জন কর্মী মাঠে কাজ করছেন। ঝড়ে নষ্ট হয়েছে পাঁচটি ট্রান্সফরমার ও ৫৫টি মিটার। তবে সন্ধ্যার মধ্যেই লাইন চালু করার জন্য চেষ্টা চলছে।
১০ হাজারের বেশি টাওয়ার বন্ধ, মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত : ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বিদ্যুৎবিভ্রাটে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) সেবা দিতে পারছে না। এর প্রভাব পড়েছে দক্ষিণের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ আরও কয়েকটি জেলার মানুষ এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা পোর্টেবল জেনারেটর দিয়ে কিছু টাওয়ার চালু করার চেষ্টা করছি। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় এসব জেনারেটরের জন্য ডিজেল সরবরাহ কঠিন হবে। টেলিকম কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, একটি বিটিএসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাটারি ব্যাকআপের সময়কাল সাধারণত ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা, যা বিদ্যুৎপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে। স্বল্প থেকে মাঝারি সময়ের বিদ্যুৎবিভ্রাট হলেও এ ব্যাকআপের মাধ্যমে টাওয়ার চালু থাকে।
৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন পিরোজপুর : পিরোজপুর জেলা প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। পিরোজপুর সদর উপজেলার নামাজপুর, ভাইজোড়া, শারিকতলা, পাড়েরহাটসহ জেলার কাউখালী, ইন্দুরকানী, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া, নাজিরপুর ও নেছারাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার লোক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

পিডিবি জানিয়েছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তারা উপকূলীয় এলাকায় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় সারা দেশের অনেক বৈদ্যুতিক পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মূলত খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর আবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হবে। উৎপাদন কমেছে পিডিবির। চাহিদা কমে যাওয়ায় পিডিবি রোববার তাদের গড় উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। বর্তমানে তারা ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পিডিবির উৎপাদন ছিল ১৩ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট। সোমবার বিকেল ৩টায় এর উৎপাদন নেমে এসেছে ৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/809955