২৮ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ৫:৩৭

একটু দুর্যোগেই ঢাকার সবকিছু অচল, তবু এত বড়াই আমাদের

-গালিব আশরাফ

মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হওয়ার পর থেকে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে কারওয়ান বাজার অফিসে আসার যে দুর্ভোগ, তা একদম ভোজবাজির মতো নাই হয়ে গেল। আগে যেখানে এক-দেড় ঘণ্টা হাতে নিতে বের হতে হতো, সেখানে এখন একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে আধা ঘণ্টা আগে বের হলেই চলে।

আজও রোজকার নিয়মে আটটার অফিস ধরতে সাড়ে সাতটায় বের হলাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। মেট্রোস্টেশনের নিচে এসে প্রথম ধাক্কা খেলাম এস্কেলেটর বন্ধ পেয়ে। সিঁড়ি বেয়ে আরও অনেকের সঙ্গে ওপরে উঠে শুনলাম, মেট্রোরেল আজ বন্ধ। দায়িত্বরত কেউ বলতে পারলেন না কখন চালু হবে বা আদৌ চালু হবে কি না।

অগত্যা নিচে নেমে এলাম, দেখলাম তখনই অফিস, স্কুলগামী কয়েক শ মানুষ ও শিক্ষার্থী তীর্থের কাকের মতো একটা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। বাসে ওঠার কোনো জো নেই। মানুষ নয়, যেন বাদুড় ঝুলছে। বৃষ্টির দাপটে বাইকেও ওঠার উপায় নেই, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ফাঁকা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

আস্তে আস্তে সময় বাড়তে লাগল, অফিসগামী মানুষের মধ্যে বাড়তে থাকল অস্থিরতা। সকাল সাড়ে আটটার দিকে একটা বাইক কোনোমতে পেলাম। বাইকার ‘ভদ্রলোক’ ভাইটি জানালেন, ৫ কিলোমিটারের জন্য আমাকে ৩৫০ টাকা দিতে হবে!

আমি ওনার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম, এই ভদ্রলোকই হয়তো পবিত্র রমজানের সময় খেজুর বা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মুণ্ডুপাত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। হয়তো ১২০ থেকে ১৫০ টাকার ভাড়া ৩৫০ দিয়েই উঠে পড়তাম, কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় উনি সিদ্ধান্ত বদলে জানালেন, ‘না ভাই, যাব না।’

ততক্ষণে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে মানুষের সারি বেড়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ স্কুলে যাবে, কারও পরীক্ষা, কারও ব্যক্তিগত জরুরি কাজ। একজনকে পেলাম, যিনি মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিতে যাবেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক ধরে গাড়ির অপেক্ষা করে কাঁদো কাঁদো হয়ে অপেক্ষারত আত্মীয়কে ফোন দিয়ে দেরি হওয়ার কারণ জানাচ্ছেন।

এক মা তাঁর স্কুলছাত্রী মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছেন। সকাল ১০টায় পরীক্ষা, সময় বাকি আছে আধা ঘণ্টার মতো। উনি উদ্‌ভ্রান্তের মতো যে গাড়িই আসছে, সেটাকেই থামানোর চেষ্টা করছেন। ভদ্রমহিলার অবস্থা দেখে দায়িত্বরত এক মধ্যবয়সী ট্রাফিক পুলিশ ভাই এলেন। পুলিশের একটি ভ্যান আসছে দেখে সেটা থামালেন। গাড়ির চালককে বিষয়টি জানাতে তিনি মা-মেয়েকে পেছনে উঠতে বললেন।
কিন্তু চালকের পেছনে বসা এক কর্মকর্তার বোধ হয় বিষয়টি পছন্দ হলো না। কালো গ্লাস নামিয়ে তিনি ট্রাফিক পুলিশকে কী বললেন, সেটা দূর থেকে পুরোপুরি বোঝা গেল না। তবে তিনি যে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা তাঁর পরোপকারী সহকর্মীর ওপর নাখোশ হয়েছেন, সেটা স্পষ্টই অনুমান করা গেল।

অফিসারের কথা শুনে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্য ততক্ষণে গাড়ির পেছনে উঠে বসা মা-মেয়েকে নামতে বলতেও উদ্যত হলেন; এরই মধ্যে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে সুর উঠল, ‘দেখেন, উপকার করতে গিয়া উনি অফিসারের ঝাড়ি খেলেন!’ যাহোক, শেষ পর্যন্ত বোধ হয় অফিসারের ‘দয়া’ হলো, মা-মেয়েকে আর নামতে হলো না।

প্রতিটি বাসেই দরজায় বিপজ্জনকভাবে ঝুলন্ত যাত্রী থাকলেও পেছনের অংশ ছিল একদমই ফাঁকা। এই যাত্রীদের কেউই বাইরে অপেক্ষমাণ শত শত মানুষ দেখেও কেন একটু পিছিয়ে আরও দশজন মানুষকে ওঠার সুযোগ দিলেন না? আমি তো উঠেছি, অন্যরা চুলায় যাক—এই অসুস্থ মানসিকতা থেকে আমরা আসলে কবে বের হব?

এদিকে একের পর এক বাস আসে, কিন্তু কোনোটিই শেওড়াপাড়া থামে না। কদাচিৎ দু-একটি থামলে অসীম সাহসী দু-একজন হাতল ধরে কোনোমতে বিপজ্জনকভাবে ঝুলতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভেবে গন্তব্যে রওনা হচ্ছিলেন। আমরা যারা কিছু হলেই কর্তৃপক্ষকে দোষ চাপাই, আমরা নিজেরা আসলে কতটা সভ্য?

প্রতিটি বাসেই দরজায় বিপজ্জনকভাবে ঝুলন্ত যাত্রী থাকলেও পেছনের অংশ ছিল একদমই ফাঁকা। এই যাত্রীদের কেউই বাইরে অপেক্ষমাণ শত শত মানুষ দেখেও কেন একটু পিছিয়ে আরও দশজন মানুষকে ওঠার সুযোগ দিলেন না? আমি তো উঠেছি, অন্যরা চুলায় যাক—এই অসুস্থ মানসিকতা থেকে আমরা আসলে কবে বের হব?

অবশেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মানুষের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কেউ একজন খবর দিলেন, উত্তরার দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে। সবাই হাঁচড়েপাঁচড়ে স্টেশনের দিকে দৌড় দিলেন। ততক্ষণে এখানেও বিশাল লাইন, কারও কারও লাইন ভেঙে সামনে যাওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে ঝগড়া-বাহাস। অবশেষে একটি ট্রেন মিস করে পরের ট্রেনে কোনোমতে উঠতে পারলাম। দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে অফিসে পৌঁছলাম। লিফটে উঠতে উঠতে সহকর্মীদের দুর্ভোগের গল্প শুনলাম।

সহকর্মী সাইফুল্লাহ রিয়াদ বনশ্রী থেকে কারওয়ান বাজার এসেছেন ৪৮০ টাকা উবার ভাড়া দিয়ে। সবাই কিছু না কিছু দুর্ভোগ পাড়ি দিয়েই গন্তব্যে পৌঁছেছেন।

অফিস এসে ভাবলাম, এমন এক মেগাসিটিতে আমরা থাকি, যেখানে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই শহর তলিয়ে যায়, ছিঁড়ে পড়া বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে মানুষকে মারা যেতে হয়, হাজারো মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও বাসযাত্রীরা এক হাত পিছিয়ে অন্যকে ওঠার সুযোগ দিতে চায় না, যেখানে দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।

এগুলোই আমাদের নিয়তি? একটু দুর্যোগেই সবকিছু অচল হয়ে যায়, তারপরও আমরা এত কিসের বড়াই করি?
• গালিব আশরাফ প্রথম আলোর সহসম্পাদক

https://www.prothomalo.com/opinion/column/20c5v1tbzo