ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিংপেগ’ চালু করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এর সঙ্গে ১ টাকা যোগ ও ১ টাকা বিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর মানে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৮ টাকা। যা এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিক দর। এতদিন ডলার বিক্রির আনুষ্ঠানিক দর ছিল ১১০ টাকা। আর ব্যাংকগুলো কিনত ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায়।
বুধবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে এখন ডলারের দর বাড়বে। এতদিন অনানুষ্ঠানিকভাবে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকায় ডলার বেচাকেনা হচ্ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় ও রপ্তানিকারকরা লাভবান হবেন। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমদানিকারক ও সাধারণ ভোক্তারা। কারণ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম যেন কোনো অবস্থায় না বাড়ে সেদিকে বেশি জোর দিতে হবে।

জানা গেছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিংপেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিংপেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এ দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।

বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। আইএমএফের চাওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পথে এগোয়। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সাস্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকভিত্তিক দুটো সংগঠন ডলারের দাম ঠিক করে আসছিল। সর্বশেষ তারা ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকায় নির্ধারণ করেছিল।

নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, যদি ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক, তবে সমানভাবে করতে হবে। ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে বড় জোর এক টাকার ব্যবধান থাকতে পারে। এর বেশি নয়। এতদিন বেচতে গেলে কম পেয়েছি। আবার কিনেছি বেশি দামে। তা যেন না হয়। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে অনেক বেশি। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, বুধবার থেকেই মার্কিন ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রলিংপেগ বিনিময় পদ্ধতি চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ডলারের জন্য ‘ক্রলিংপেগ মিড-রেট’ (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে আন্তঃব্যাংক ও গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনে তফশিলি ব্যাংকগুলো সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ক্রলিংপেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। ফলে দাম একবারে খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিুসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলারের লেনদেনের ক্ষেত্রে এই দরের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে।

ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এই পদ্ধতি চালুকে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হিসাবে উল্লেখ করেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলার কেনাবেচা করতে পারবে। তবে এই দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে।

ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করেন এ ব্যাংকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এখন থেকে ডলারের দাম নির্ধারণে বাফেদা বা এবিবির কার্যত কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ক্রলিংপেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে এই পদ্ধতি চালু হবে, তা নিয়ে আইএমএফের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করার কথা বললেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসংক্রান্ত ঘোষণা দিল।