৫ মে ২০২৪, রবিবার, ৬:৩২

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে কেন এই অবনতি

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ২৭ দশমিক ৬৪ স্কোর নিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানের পেছনে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব জুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এই সূচক প্রকাশ করেছে। কেন গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে এই অবনতি? এর উত্তরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পেছানোয় আমি মোটেও অবাক হয়নি। দুই ধাপ পিছিয়েছে এবার সেইসঙ্গে গত ছয় বছরে ১৯ ধাপ পিছিয়েছে। ক্রম অবনমন হচ্ছে। এতে তিনটা দিক নির্দেশ করে। প্রথমত, মুক্ত গণমাধ্যমের অবনমন হচ্ছে আইনি কাঠামোর কারণে।

গণমাধ্যমকে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধে রূপান্তর করা হয়েছে। আইনের কিছু পরিবর্তন যদিও আনা হয়েছে। কিন্তু এতে পরিবর্তন কিছুই হয়নি। এটা নতুন বোতলে পুরনো মদ। গণমাধ্যমে বিবর্তনমূলক যে ধারাগুলো আছে এগুলো পরিবর্তন হয়নি। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে সুরক্ষা দেবার যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে এটা ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। গণমাধ্যমবিরোধী অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। তৃৃতীয়ত, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গণমাধ্যমে স্বাধীনতা রক্ষা পরিপন্থি চর্চা স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো, গণমাধ্যমকর্মী এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের সুরক্ষা যারা দেন তাদের একটা হুমকি, নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই ত্রিমুখী পরিবেশের প্রতিফলন ঘটেছে সূচকে। এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক একটা বিষয় এবং অশনি সংকেত বলে মনে করি। আমাদের স্বাধীনতার যে চেতনা, স্বপ্ন এটা ধূলিস্যাত করার জন্য এটার থেকে বড় আর কিছু হতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, শাসকবর্গ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা চালু করেছে। সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। সাংবাদিকদের জেলে পুরছে, সেইসঙ্গে আছে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। সমস্ত আইন-কানুন, রীতিনীতি সবই হচ্ছে সরকারের ইচ্ছায়, সবই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার বিরোধী। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এক দলীয় ব্যবস্থার কারণে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দ্বিমত, ভিন্নমত নষ্ট হয়ে গেছে। এরই প্রভাবটা গণমাধ্যমের সূচকে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, দেশে অনেক গণমাধ্যম আছে যারা সরকারের পক্ষে কথা বলার জন্য বের হয়। লাইসেন্স পায়, বিজ্ঞাপন পায়। কিন্তু এই গণমাধ্যমগুলো সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য কিছুই করে না। কোয়ালিটি জার্নালিজমের জায়গাটা কমে যাচ্ছে। অনেক গণমাধ্যমকর্মী ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এটাও সাংবাদিকতার জন্য ভালো লক্ষণ না।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে শীর্ষস্থানে রয়েছে নেপাল। ৬০ দশমিক ৫২ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ৭৪তম। ৫২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট নিয়ে পরের অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। দেশটি ১০৬তম অবস্থানে। এবারের তালিকায় প্রথম অবস্থান থেকে ছিটকে তৃতীয় স্থান পেয়েছে ভুটান। ৩৭ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারত। এই তিন দেশের বৈশ্বিক অবস্থান যথাক্রমে ১৫০, ১৫২ ও ১৫৯তম। গত বছরের ১৬১ থেকে দুই ধাপ এগিয়ে এবার ১৫৯তম অবস্থান পেয়েছে ভারত। আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বশেষ স্থান পেয়েছে। ২৬ ধাপ পিছিয়ে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১৭৮তম, পয়েন্ট মাত্র ১৯ দশমিক ০৯।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করলেও তা পরিস্থিতি উত্তরণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই বেশি দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, মানুষের আস্থা আইনশৃঙ্খলার ওপর নেই। পাশাপাশি সংবাদপত্রের মালিকানা চলে গেছে কর্পোরেট হাউসগুলোর কাছে এবং তারাই সব নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সর করছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতার পরিস্থিতিটাই আর সুস্থ নেই।

https://mzamin.com/news.php?news=108407