১ মে ২০২৪, বুধবার, ১১:১৮

তীব্র দাবদাহের কবলে জরাজীর্ণ রেলপথ

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই লাইন বাঁকা হচ্ছে, দাবদাহ মুখ্য নয় -ড. এম সামছুল হক

ভারতেও তীব্র দাবদাহ চলছে। সে দেশে রেললাইন বাঁকা হওয়ার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনের গতিও কমাতে হচ্ছে না। কিন্তু, বাংলাদেশে দাবদাহে রেল লাইন বাঁকা হচ্ছে। রেলসংশ্লিষ্টরা সূর্যের অতিরিক্ত তাপকে দায়ী করেই চুপচাপ থাকছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সূর্যের তাপ রেলের জরাজীর্ণ লাইনকে খুব সহজেই ঘায়েল করতে পারছে। পর্যাপ্ত পাথর, স্লিপার, নাটবল্টুবিহীন রেললাইন ক্ষয় হয়ে আছে যুগের পর যুগ। ওই অবস্থায় চলমান দাবদাহে জীর্ণ ক্ষয় হওয়া রেললাইন বাঁকা হচ্ছে। এদিকে মঙ্গলবারও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের পুবাইল সেকশনে রোদের তাপে লাইন বাঁকা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া যশোর-চুয়াডাঙ্গা রেল সেকশনের লাইন বাঁকা হওয়ার ঘটনায় সর্বনিম্ন গতিতে ট্রেন চালানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা যদি ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে তাহলে রেললাইনের ওপরে সূর্যের তাপ ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। যেহেতু রেলের পাত লোহা দিয়ে তৈরি এবং সূর্যের তাপে লোহা অতিরিক্ত গরম হয়। সম্প্রতি দেশের কোথাও কোথাও ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি সে.গ্রে. তাপমাত্রা বিরাজ করছে। স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে রেলের তাপ ১০ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে। অর্থাৎ বর্তমানে ৪৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা হলে রেলপথে সেই তাপমাত্রা পৌঁছবে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ভারত কিংবা উন্নত দেশের রেললাইনের পাত তুলনামূলক প্রশস্থ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা সেই পাতকে ঘায়েল করতে পারে না। ৬০ থেকে ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেও সেই সব দেশে রেললাইন বাঁকা হয় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, যারা শুধু দাবদাহকে দায়ী করছে-সেখানে ভাঁওতাবাজি রয়েছে। সারা দেশেই তীব্র দাবদাহ চলছে। যেসব জেলায় যখন তীব্র তাপমাত্রা হচ্ছে, সেখানকার রেললাইন তো মাইলের পর মাইল বাঁকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাঁকা হচ্ছে জরাজীর্ণ সেকসানগুলোতে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এসব লাইন চরম জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাথর নেই, নড়বড়ে স্লিপার, নাটবল্টু, হুক-ক্লিপ খেলা অবস্থায় পড়ে থাকে মাসের পর মাস। অর্থাৎ রেলে উন্নয়নের দৌড়ে-রক্ষণাবেক্ষণ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। জীর্ণ লাইনগুলো বাঁকা হচ্ছে। এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ, এমন সমস্যার সঙ্গে ট্রেন যাত্রীদের জীবন-মরণের সম্পর্ক রয়েছে।

রেলওয়ে প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রেলের শুধু মিটারগেজ লাইন তীব্র তাপে বাঁকা হয়ে পড়ছে। পানি কিংবা পাটের বস্তা ভিজিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে মাঠপর্যায়ের রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাধ্য হয়ে সর্বনিম্ন গতি (৫ থেকে ১৫) নিয়ে কোনো কোনো সেকশনের ট্রেন চালানো হচ্ছে। এতে করে কোনো কোনো ট্রেন গড়ে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বিলম্বেও চলাচল করছে। মিটারগেজ লাইনের পাত-প্রতি ১ মিটারের ওজন হয় ৩২ কেজি। আর ব্রডগেজ ১ মিটার পাতের ওজন হয় ৬০ কেজি। কম ওজনের মিটারগেজ লাইনের অধিকাংশ লোহার পাত ক্ষয় হয়ে রয়েছে। এছাড়া যে পরিমাণ পাথর লাইনে থাকার কথা তার অর্ধেকেরও কম পাথর রয়েছে লাইনগুলোতে। বিভিন্ন সেকশনে লাইন ক্ষয়ের সঙ্গে নড়বড়ে স্লিপার, নাটবল্টু খোলা অবস্থায় রয়েছে। এমন অবস্থায় সূর্যের তাপে খুব সহজেই বিভিন্ন সেকশনের লাইন বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ) দপ্তর সূত্র বলছে, পূর্র্বাঞ্চল রেলে মোট ১৫৫৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। যার মধ্যে মিটারগেজ রেলপথ রয়েছে ১৩০০ কিলোমিটার। পুরো রেলপথেই পাথর স্বল্পতা আছে। রেলওয়ে নিয়ম অনুযায়ী লাইন যে পরিমাণ পাথরের থাকার কথা তার অর্ধেকেরও কম পাথর রয়েছে। তাছাড়া প্রতিবছর নিয়ম অনুযায়ী মোট পাথরে ৫ শতাংশ পাথর রেলপথে ঢালতে হয়। যা বছরের পর বছর যথাযথভাবে ঢালা হচ্ছে না। এমন অবস্থায় কোন কোন সেকশনে নামেমাত্র পাথর রয়েছে। নড়বড়ে স্লিপারে নাটবল্টু, হুক খুলে আছে। ওই সব সেকশনেই তীব্র রোদে লাইন বাঁকা হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

মঙ্গলবার গাজীপুরের পুবাইল এলাকায় রেললাইন বেঁকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে প্রায় ২ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। গাজীপুরের পুবাইল রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. আব্দুর রহমান জানান, ওই পথটি মিটারগেজ লাইন। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ৩৮৪/৪৪ এলাকায় রেললাইন বেঁকে যায়। বিষয়টি তাৎক্ষণিক রেললাইনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের জানানো হয়। এ সময় ঝুঁকি এড়াতে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। যুগান্তররের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, রোদের তাপে কালীগঞ্জের আড়িখোলা স্টেশন এলাকায় রেলপথের একাধিক স্থানে রেললাইন বাঁকা হয়ে পড়ে। কোথাও ১০ ফুট আবার কোথাও ১২ ফুট পর্যন্ত লাইন বাঁকা হয়ে পড়ে। স্থানীয় রেলওয়েকর্মীরা কচুরিপানা, কাদামাটি ও পানি দিয়ে বেঁকে যাওয়া পাত সোজা করার চেষ্টা করেন। রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এর আগেও চলতি মাসে (এপ্রিল) পূর্বাঞ্চল রেললাইন বাঁকার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫টি। নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রেন চালালেও লাইন বাঁকা হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলে মোট ১৬৯৯ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। যার মধ্যে ৩৫৪ কিলোমিটার রেলপথ মিটারগেজ রয়েছে। এ অঞ্চলের মিটারগেজ লাইনে লাইন বাঁকার ঘটনাও ঘটছে। মঙ্গলবার যশোর-চুয়াডাঙ্গা রেললাইন সেকশনে লাইন বাঁকা হওয়ার উপক্রম হয়। ওই অঞ্চলের এক প্রকৌশলী জানান, যশোর-চুয়াডাঙ্গা মিটারগেজ লাইনের অবস্থা খুবই করুণ। বিভিন্ন সময় পাথর দেওয়া ও সংস্কার কাজ করা হলেও, তা ছিল শুধুই নামে মাত্র। লাইন ক্ষয় হয়ে অর্ধেকে নেমে আছে। ক্ষয় হওয়া লাইন মেরামত করা হচ্ছে না।

জানা যায়, অধিকাংশ রেলপথ ব্রিটিশ আমলে নির্মিত । মোট রেললাইনের ৯০ শতাংশ নির্মিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজনের আগে। যার অধিকাংশই মেয়াদোর্ত্তীণ-কোন কোন সেকশনের আয়ুস্কাল শেষ হয়ে গেছে ২০ থেকে ৩০ বছর আগেই। যার মধ্যে আখাউড়া সিলেট, জামালপুর, টঙ্গী-নরসিংদী সেকশন ও গফরগাঁও-মশাখালী সেকশন এবং পশ্চিমাঞ্চলের যশোর-চুয়াডাঙ্গা সেকশনের লাইনগুলো অতি পুরোনো। এসব সেকশন সবচেয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জরাজীর্ণ এসব লাইনে প্রায়ই লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। এছাড়া বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি ঢলে এসব সেকশনে রেললাইন ও রেলওয়ে ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সূত্র বলছে, রেলের দু’অঞ্চলে প্রায় ১২ লাখ কিউবিক মিটার পাথরের ঘাটতি আছে। ঘাটতি পাথর পূরণ না করায় লাইন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আরিফুজ্জামান বলেন, মিটারগেজ লাইনকেই তীব্র দাবদাহ ঘায়েল করছে। আমরা এসব লাইন পরিবর্তন করছি। সব মিটারগেজ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করছি। লাইনের প্রশস্থতা বাড়ানো হচ্ছে। রোদের ব্রডগেজের লাইন বাঁকা হচ্ছে না। সমস্যা দেখা দিচ্ছে মিটারগেজ লাইনে। রক্ষণাবেক্ষণেও আমরা জোর দিচ্ছি। যথাযথ বরাদ্দের প্রয়োজনও রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/800412