২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১১:১৭

মার্কিন রিপোর্টে যুদ্ধাপরাধ, বেগম খালেদা জিয়ার বিচার ও বন্দিত্ব নিয়ে প্রশ্ন

-আসিফ আরসালান

বিচার বিভাগ, বিশেষ করে উচ্চ আদালত সম্পর্কে লিখতে গেলে আমাদেরকে অর্থাৎ সাংবাদিক, বিশেষ করে কলামিস্ট বা রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থাকতে হয়। কারণ কোনটা যে আদালত অবমাননা এবং কোনটা যে আদালত অবমাননা নয়, সে ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব জটিল। তবুও কতগুলো বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে লেখা যায়। যেমন হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি। বলা হয় যে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেন। প্রতিবারই তাই হয়। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়। দেখা যায় যে সিনিয়র মোস্টকে ডিঙ্গিয়ে অনেক জুনিয়র বিচারপতিকে প্রমোশন দিয়ে আপিল বিভাগ বা সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অতীতে এগুলো নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেবো। প্রথমটি হলো, শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ। হাইকোর্টের ৪০ জন সিনিয়র বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ৪০ জন বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে মানিকের মতো একজন জুনিয়রকে যে রাজনৈতিক কারণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেটি পরবর্তীতে পরিষ্কার হয়ে গেছে। মানিক বিচারপতি থাকাকালীন পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। অবসর নেওয়ার পর তার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথে মাখামাখিতে বোঝা যায় যে তিনি কেমন কট্টর আওয়ামীপন্থী ব্যক্তি।

এবার হাইকোর্টের তিন জন বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তারা প্রধান বিচারপতির নিকট থেকে শপথ গ্রহণ করেন। এই ৩ জন বিচারপতি হলেন বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ, বিচারপতি মোহাম্মদ শাহিনুল ইসলাম এবং বিচারপতি কাশেফা হোসেইন। ২৫ এপ্রিল ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যায় যে এবারও এই তিন বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিচারপতি হাফিজের চেয়ে সিনিয়র হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী। তাকে টপকেছেন বিচারপতি হাফিজ। আর জাস্টিস শাহিনুল ইসলাম এবং কাশেফা হোসেইন ৪০ জন বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন পেয়েছেন। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। বিচারপতি হাফিজ ৩১ মে অবসর গ্রহণ করবেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তাকে মাত্র ৩৭ দিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাত্র ৩৭ দিনের জন্য সালমা মাসুদকে কেন ডিঙ্গানো হলো সেটার কোনো বোধগম্য কার নেই। আর জাস্টিস হাফিজ রিটায়ার করলেই যে সালমা মাসুদ সুপ্রিম কোর্টে যাবেন তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? জাস্টিস শাহিনুল ইসলাম ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল এবং জাস্টিস কাশেফা হোসেইন ২০২৫ সালের ৩০ জুন অবসর গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ এই তিন বিচারপতি সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য নিয়োগ পেলেন। আর সেটাও পেলেন ৪০ জনকে ডিঙ্গিয়ে (পরবর্তী দুই জন)।
এগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। কিন্তু মানবিক দিকটা দেখুন। বিচারপতি ওয়াহাব মিঞাকে ডিঙ্গিয়ে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। মনের দুঃখে বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে ডিঙ্গিয়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে চীফ জাস্টিস করলে মনের দুঃখে বিচারপতি মমিনুর রহমান স্বেচ্ছায় প্রি-ম্যাচিওর রিটায়ারমেন্ট গ্রহণ করেন।

আমরা আগেই বলেছি যে এগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। তবে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ যে রিপোর্ট করেছে তাতে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে প্রমোশন পাওয়ার আগে বিচারপতি শাহিনুর রহমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১০ বছর বিচারপতি হিসেবে কাজ করেন। হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে বিচারপতি শাহিনুর রহমান সিনিয়র জেলা জজ হিসেবে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেন। তিনি ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তাকে হাইকোর্টে ফেরত আনা হয়। তাই বিষয়টি নিয়ে জনমনে নানাবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

॥ দুই ॥
দুর্নীতি নিয়ে বিগত ১৫ বছর অনেক কথা লেখা হয়েছে। যদি এই সব রিপোর্ট, মন্তব্য ইত্যাদি সংকলন করা হয় তাহলে মোটা মোটা কয়েকটি খন্ডে লিখতে হবে। কিন্তু তারপরেও সেগুলো থামছে না। থামবে কেন? পুকুর চুরি করেও যদি পার পাওয়া যায় তাহলে মানুষ পুকুর চুরি করবে না কেন? এমনি একটি উদাহরণ হলো, প্রমথ রঞ্জন ঘটক। তিনি ছিলেন মাদারীপুরের ভূমি অধিগ্রহণ অফিসার (ল্যান্ড এ্যাকুইজিশন অফিসার) ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকার তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হয়। সেই অভযোগটি প্রমাণিতও হয়েছে। এমন বিরাট একটি অংকের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও তার কি শাস্তি হয়েছে? ২৫ এপ্রিলের ইংরেজি ডেইলি স্টারের এসম্পর্কিত রিপোর্টের শিরোনাম, Just a slap on the wrist? Govt officer gets a mere demotion for involvement in Tk. 7.38cr embezzlement. অর্থাৎ “কব্জিতে শুধুই একটি চড়? / ৭ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা তহবিল তছরুপের পরেও শুধুমাত্র পদাবনতি”। ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে কিভাবে রঞ্জন ঘটক তহবিল তছরুপ করেছেন।
এই খবরটি পড়ে মানুষ শুধু ক্ষুব্ধই হননি, রীতিমত বিস্মিত হয়েছেন। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক নাম এবং পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিটিং জয়েন সেক্রেটারি বলেছেন, “প্রশাসনে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও দেখা যায় যে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়নি। এরফলে প্রশাসন দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ অফিসাররা মনে করছেন যে দুর্নীতি করলেও কোনো বড় শাস্তি ছাড়াই পার পাওয়া যায়।”

॥ তিন ॥
বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে হরেক রকম কথা রয়েছে। আওয়ামী লীগ তো প্রকাশ্যে মার্কিন বিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ সমস্ত বিরোধী দল আমেরিকার ওপর নাখোশ। তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি দৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে আমেরিকার ভূমিকা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। এটি প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সর্বশেষ রিপোর্টে। বিশাল এই রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে আমরা এখানে ঐ রিপোর্টের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব যুদ্ধাপরাধ ও নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে তার বিচার করার জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। সেই আদালত শাস্তি দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে মৃত্যুদ-। অনেক পর্যবেক্ষক এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দেখেন। কারণ, আদালত বিশেষত বাছাই করে অভিযুক্ত করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের। এতে খেয়ালখুশিমতো ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বেআইনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার তদন্ত তারা নিজেরাই করেছে। তারা এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছে যেখানে তাদের মারাত্মক প্রহারে মানুষ আহত হয়েছেন অথবা মারা গেছেন। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে কতজন মানুষ মারা গেছেন তার মোট কোনো সংখ্যা সরকার প্রকাশ করেনি। এমনকি এসব ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তও করেনি। এই তদন্ত যারা করেছেন তাদের স্বাধীনতা ও পেশাগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বছরেই আইন প্রয়োগকারীরা তল্লাশি বা রেইড দিয়েছে কথিত সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ড, মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে।”

রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, “২০২৩ সালেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসনকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে বাংলাদেশের হাসপাতালে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে ২০০৮ সালের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তাকে জেলখানা থেকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালে সেখান থেকে তাকে স্থানান্তর করে গৃহবন্দি করা হয়। রাজনৈতিক বন্দি ও আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও দেশের ভিতরকার আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার তথ্যপ্রমাণে ঘাটতি আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক ছক সাজানো হয়েছে।”

মার্কিন রিপোর্টটি এমন দ্ব্যর্থহীন যে এ সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

https://www.dailysangram.info/post/554675