২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১১:০৩

কমেনি লোডশেডিং জনদুর্ভোগ চরমে

উৎপাদন বাড়লেও তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে সারা দেশে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তীব্র লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। চলতি মাসের ২২ এপ্রিল দেশে ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। যা এ যাবৎকালে দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু তার পরও কমেনি লোডশেডিং। এদিকে গরমের মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারনে চরম দুর্ভোগে আছে ভুক্তভোগীরা।

দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। আরইবির জোনভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যে দেখা গেছে, গত মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে এ বিতরণ কোম্পানিকে এক হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে।

এ সময় সারা দেশে কোম্পানিটির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৮৯৬ মেগাওয়াট, সরবরাহ করেছে ৭ হাজার ১৫২ মেগাওয়াট। মঙ্গলবার আরইবির বিতরণ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। অঞ্চলটিতে লোডশেডিং হয়েছে ৫১৭ মেগাওয়াট, যা ছিল ৪২ শতাংশ লোডশেডিং। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৪৯ মেগাওয়াট, ঢাকাতে ৫৬৩ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় ২৩০ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ২০৭ মেগাওয়াট ও রংপুরে ৭৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। তবে বরিশাল, সিলেট ও খুলনায় এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।

আরইবির এক পরিচালক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের বিতরণ এলাকায় যে চাহিদা রয়েছে, সেই তুলনায় বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। যার কারণে এ গরমের মধ্যেও বাধ্য হয়ে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা বাবলু বলেন, ‘প্রায় সারা রাত বিদ্যুৎ ছিল না। আমাদের গ্রামে দিনে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। সরকার দাবি করছে যে, দেশের বিদ্যুতের সক্ষমতা ১০০ ভাগ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। সরকারের উচিত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।’

নরসিংদীর বাসিন্দা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এখন লোডশেডিং খুব বেশি। পরিস্থিতি অসহনীয়। অনেক দিন আগেও তাপপ্রবাহে বিদ্যুৎ ছিল না। মশার সমস্যার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের তীব্র দুর্ভোগও রয়েছে।’

ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহে ২৩ এপ্রিল দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এক হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এবারই প্রথম বিদ্যুতের ঘাটতি এত বেশি দেখা দিয়েছে। ২২ এপ্রিল সর্বোচ্চ ৯৬৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং রেকর্ড করা হয়। অথচ এদিন ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড গড়ে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২৩ এপ্রিল বিকাল ৩টায় দেশে চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, তখন লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ৪৯ মেগাওয়াট। অন্যদিকে ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং সরবরাহের পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে তাতে এ বছর ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন করা হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবছর নতুন করে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় লোডশেডিং কমছেÍ এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।’

বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায়, এ গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিংয়ের মাত্রা গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়াতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। এদিকে রাজধানীতে বিদ্যুত সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। লোডশেডিং না হলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানা যায়।

তবে ফিডার ওভারলোডের কারনে ডিপিডিসির আওতাধীন বনশ্রীর সিঙ্গাপুর রোডে বিদ্যুতের গ্রাহকদের ভোগান্তি চরমে। বৈদ্যুতিক লাইনের কারিগরি ত্রুটির কারনে দক্ষিণ বনশ্রী থেকে পূর্ব মাদারটেকে গত ১ বছর ধরে প্রতিদিন অন্তত আট থেকে দশবার করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। আর এ বিভ্রাটে প্রতিবারই এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে এ এলাকার প্রায় ১৫ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। ডিপিডিসির ফিডার ওভারলোডের কারনে বনশ্রী ডিভিশনের সিঙ্গাপুর রোড ফিডারটিতে এ বিদ্যুৎ বিচ্চুতির ঘটনা ঘটছে। গ্রাহকদের এ সমস্যার কথা ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে বারবার লিখিত নোট দেয়ার পরেও এ সমস্যা সমাধানে এখনো তেমন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার বিকাল ৩টার সময় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ২০২ মেগাওয়াট। তখন লোডশেডিং হয় ১০৪৯ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে আমরা ফুললোডে চালাতে বলছি। কিন্তু এখানে বড় বিষয় হলো ফাইন্যান্স। আমাকে নিয়মিত গ্যাস দিতে হবে। আমি তো পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে বসে আছি। আমার মেইন চ্যালেঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চালু রাখা। তাদের ফাইন্যান্স সাপোর্ট দেওয়া।’ এদিকে তাপমাত্রা আগামী ১ সপ্তাহ পর্যন্ত কমার পূর্ভাবাস নেই বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ‘আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান এ তাপমাত্রা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপরে অব্যাহত থাকবে।’

এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ৩ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাস উৎপাদন হয়েছে দৈনিক ৩ হাজার ৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে দেখা যায়, বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে যেগুলো প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে, গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২ হাজার ৩১৬ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/554639