২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৮:১০

উচ্চতাপে দিনে-রাতে দুর্ভোগ

উচ্চ তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। ঘরে-বাইরে দিনে-রাতে দুর্ভোগ অসহনীয়। প্রশান্তির মেঘের ছায়া ও বৃষ্টিপাত না হলে কমবে না গরমের কষ্ট-যন্ত্রণা। বর্ষারোহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমন হলেই নিয়মিত ও ভারী বৃষ্টিপাত হবে। তবে বর্ষার মৌসুমী বায়ুমালা আসতে এখনও অনেক দেরি। আগামী জুন মাসের প্রথম দিকে মৌসুমী বায়ু বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারে। এ অবস্থায় চলতি ভরা গ্রীষ্মকালে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) ব্যাপক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। গতবছর ২০২৩ সালের মতো এ বছরও গ্রীষ্মকাল হতে পারে দীর্ঘায়িত এবং উষ্ণতম। টানা উচ্চ তাপপ্রবাহ ও খরা-অনাবৃষ্টিতে দেশের সর্বত্র দুঃসহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। মৌসুমের এ সময়ে ‘যদি’ মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি, বজ্র বা শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড় হয় তখন সেখানে সাময়িক স্বস্তি আসতে পারে। এদিকে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানা গেছে, চলমান তাপপ্রবাহ আরো বিস্তার লাভ করতে পারে।

গতকাল সোমবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল খুলনা বিভাগের খুলনা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭.৮ এবং ২৯.৩ ডিগ্রি সে.। ঢাকাসহ সারা দেশে রাতের ‘সর্বনিম্ন’ তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ধারেকাছে উঠে গেছে! আবহাওয়া বিভাগ সূত্র জানায়, দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে গিয়ে কাছাকাছি অবস্থানের কারণে খরতাপের কষ্ট-যাতনা দিনে-রাতে সমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনভর সূর্যের তীর্যক কড়া দহনের তেজ মাটিকে উত্তপ্ত করে রাতেও সেই তাপ বিকিরণ হচ্ছে। এর ফলে খরতপ্ত আবহাওয়া পরিস্থিতি দুর্ভোগ তৈরি করেছে।

গতকাল সোমবার আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) ফের ৭২ ঘণ্টার তাপপ্রবাহের গণসতর্কতা বা হিট এলার্ট জারি করেছে। এ নিয়ে পর পর তিন দফায় হিট এলার্ট জারি করা হলো। হিট এলার্ট সতর্কতা বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ গতকাল থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায়ও (তিন দিন) অব্যাহত থাকতে পারে। বাতাসে জলীয়বাষ্প অধিক হওয়ায় জনজীবনে গরমে-ঘামের অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল রাজধানী ঢাকায় বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বা জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ছিল সকালে ৮১ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৪৪ শতাংশ। যা অস্বাভাবিক বেশি।

গতকাল দিনের উল্লেখযোগ্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল পাবনায় ৪০.৫, মোংলায় ৪০.১, রাজশাহী ও কুষ্টিয়ায় ৪০, টাঙ্গাইলে ৩৯.২, ফরিদপুরে ৩৯, গোপালগঞ্জে ৩৯.১ ডিগ্রি সে.।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় বিক্ষিপ্তভাবে শুধুই সিলেটে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া দেশের আর কোথাও ছিঁটেফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি।

উচ্চতাপ, খরা-অনাবৃষ্টির বৈরী আবহাওয়ায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। দিনমজুর, কুলি, শ্রমজীবীদের রুজি-রোজগার কমে গেছে। তাপদাহ ও খরার কবলে ফল-ফসলের মাঠ শুকিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় ইরিবোরো ধান আধাপাকা। এ অবস্থায় হিটশকে ধান চিটায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হিটশকে ফল-ফলাদি অপরিপক্ক বা গুটি অবস্থায় ঝরে পড়তে পারে। ধানের জমিতে এক-দুই ইঞ্চির মতো সেচের পানি রাখলে হিটশক মোকাবিলা সম্ভব বলে কৃষিবিদগণ জানান।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্তসহ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার (তিন দিন) আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসÑ সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।

রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার ও রাঙ্গামাটি জেলাসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারী ধরনের তাপ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ আরও বিস্তার লাভ করছে।

সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে গরমে-ঘামের অস্বস্তি বিরাজ করছে।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।

‘এত গরম আর কতদিন চলবে’? : শীর্ষক গতকাল সোমবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৪৫টির বেশি জেলার উপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একইসাথে দিনের গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সারা দেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই সোমবার আবারও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

তীব্র গরমের কারণে ইতোমধ্যেই স্কুল-কলেজে সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পাশাপাশি গরমে হিট স্ট্রোকসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এবছর এত গরম পড়ার কারণ কী? বর্তমানে যে তাপপ্রবাহ চলছে সেটিই-বা কতদিন চলবে?

‘উষ্ণতম বছর’ : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু এবছর তীব্র তাপপ্রবাহ হওয়ায় ইতোমধ্যেই তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেন, মূলত সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি সে. বেড়ে গেছে। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ৩৬ ডিগ্রি সে.। কিন্তু এ বছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সে. দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সারাদেশেই তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এ বছরের তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। সামনে গড় তাপমাত্রা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে এটি বাংলাদেশের উষ্ণতম বছরও হতে পারে। গত ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন আবহাওয়াবিদরা। গত বছর একটানা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলার রেকর্ড হয়েছিলো।

বৃষ্টি হবে কবে? : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এবছর এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম হচ্ছে। ফলে গরম থেকেই যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাত হলেই গরম কেটে যাবে। কিন্তু কবে নাগাদ সেই ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে? আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেন, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। মূলত বঙ্গোপসাগর থেকে মৌসুমী বায়ু না আসায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এ বছর মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হচ্ছে। কাজেই ভারি বৃষ্টিপাতের জন্য আমাদেরকে জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতে পারে।

তবে আগামী শুক্রবার নাগাদ দেশের কোথাও কোথাও হালকা দমকা হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে পরিমাণ কম হওয়ায় সেই বৃষ্টিপাত গরম কমানোর ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আরও তাপপ্রবাহ আসছে : বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হওয়ায় এবছর তাপপ্রবাহ সহসাই থামবে না বলে জানান আবহাওয়াবিদরা। তারা বলেন, সামনে আরও তাপপ্রবাহ আসছে এবং পুরো মে মাসজুড়ে সেটি চলতেই থাকবে। এছাড়া মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হওয়ায় এবছরের তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে। আবহাওয়াবিদ শাহ আলম আশঙ্কা করেন, এমনকি তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল আগের বছরগুলোকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে এর আগে তাপপ্রবাহ একটানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর।

তবে তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, অনেকদিন ধরে তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে কোনও কোনও এলাকার বায়ুরচাপ কমে যায়। বায়ুরচাপ কমলে সাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প বাতাসের কোথাও জড়ো হতে শুরু করে। তখন সেখানে বজ্রমেঘ তৈরি হয়। পরবর্তীতে সেই মেঘ বৃষ্টিপাত ঘটায়।
এত তাপপ্রবাহের কারণ কী? : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত কয়েকদিনের পূর্বাভাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশের ঐ অঞ্চলের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের অবস্থান। এইসব প্রদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। এসব জায়গায় বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে। ড. মল্লিক বলেন, গত বছর ভারতের ওইসব অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৫২ ডিগ্রি সে.। যেহেতু ওগুলো উত্তপ্ত অঞ্চল, তাই ওখানকার গরম বাতাস চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের তাপমাত্রাকে গরম করে দেয়।

এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশব্যাপী এবছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে। ড. মল্লিক জানান, বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি। এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশের তাপমাত্রার উর্ধ্বগতিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া লেগেছে। এছাড়া বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণেও সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।

https://dailyinqilab.com/national/article/652935