২২ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:২৭

বরেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানির হাহাকার ॥ অচল সেচ প্রকল্পগুলো

রাজশাহী: বরেন্দ্রজুড়ে পানির সংকট। (উপরে) পদ্মার বুকে চরের বিস্তার (নিচে) খরার প্রভাবে জমি ফেটে চৌচির -সংগ্রাম
সরদার আবদুর রহমান : বরেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানির হাহাকার চলছে। একদিকে এই অঞ্চলের পানির অন্যতম উৎস পদ্মা নদীর বুকে পানি প্রবাহের বদলে চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। অন্যদিকে ভূগর্ভের পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে মার খাচ্ছে সেচকেন্দ্রিক কৃষি প্রকল্পগুলো। পুড়ছে মাঠের ফসলও।

প্রতি বছর চৈত্রের খরতাপ শুরু হওয়ার আগেই রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়। এখানকার উঁচু এলাকাগুলোয় পানির সংকটের চিত্র ভয়াবহ। তার জেরে এবারেও রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরসহ আশপাশের জেলাগুলোয় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ভূগর্ভের স্তর স্বাভাবিকের অনেক নিচে
সূত্রে জানা গেছে, চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে হাহাকার উঠেছে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে। নিজ এলাকায় পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন। একজন জানিয়েছেন, বাঘা-চারঘাট এলাকায় পানি পেতে সমস্যা হচ্ছে মানুষের। এরপরও গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। অতিরিক্ত পুকুর খনন করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পুকুরে পানি ভরা হচ্ছে। এলাকায় পানিস্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার এটা বড় কারণ বলে মনে হচ্ছে।’ একজন লিখেছেন, পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর এলাকায় কোনো টিউবওয়েল থেকে পানি উঠছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি জমির সেচকাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। খাবার পানি ও সেচকাজের পানি পুরোটাই মোটর পাম্প নির্ভর হয়ে পড়েছে। আরেকজন লিখেছেন, চারঘাট উপজেলার ভায়ালক্ষীপুর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মাঠে শত শত বিঘা জমিতে পাট, তিল, ভুট্টাসহ নানা ধরনের ফসল রোপণ করেছেন কৃষকরা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পানির অভাবে কোনও জমিতে সেচ দেয়া হয়নি। যার কারণে জমিতে পাট, তিল, ভুট্টাসহ কোনও ফসলের চারা বের হয়নি। যদি এই এলাকার মাঠকে কোনও সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়, তাহলে ফসল উৎপাদন সহজ হবে। পাশাপাশি এলাকার টিউবওয়েলেও পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি অর্থায়নে যদি গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয় তাহলে মানুষের কিছুটা হলেও কষ্ট দূর হবে।
মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা যাচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ঝিলিম ইউনিয়ন, গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর, রহনপুর ও পার্বতীপুর ইউনিয়ন এবং নাচোল উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন চরম পানি সংকটাপন্ন এলাকা। রাজশাহী জেলার পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর ও মাটিকাটা ইউনিয়ন ছাড়া সবগুলোর ভূগর্ভের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তানোর উপজেলার পাচন্দর, মু-ুমালা, কলমা ও বাধাইড় ইউনিয়নে অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

টিউবওয়েলে পানি ওঠে না
জনস্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আশি ও নব্বই এর দশকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন করা হয় যেগুলো পানি চাহিদা মেটাতো। এমন কয়েক লক্ষাধিক হস্তচালিত নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপই এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ক্রমাগত পানি চাহিদা সংকট মেটাতে এখন গ্রামাঞ্চলে সাবমারসিবল পাম্প বরাদ্দ ও স্থাপন করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জল মোটর দেয়া হচ্ছে। অনেকেই নিজের টাকায় মোটর স্থাপন করছে। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, রাজশাহী নগরীতে থাকা হস্তচালিত নলকূপগুলো থেকে এখন আর কোনও পানি পাচ্ছেন না নগরবাসী। অন্যদিকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে থাকা হস্তচালিত নলকূপেও কোনও পানি উঠছে না। রাজশাহীর তানোর উপজেলার একজন জনপ্রতিনিধি জানান, শুষ্ক মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় পানি সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এলাকার মানুষের পানির প্রাপ্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ ও পুকুর। তাও লোকজনকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পানি সংগ্রহের কষ্টটাই এখন এলাকার মানুষের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রাম জনপদে ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যায় প্রতি বছর। গত কয়েক বছর ধরে এমনটা দেখা যাচ্ছে। এ বছর পরিস্থিতি আরো সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহী অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ঊর্ধ্বে ৪০ এবং নি¤েœ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। এই সময়ে বরেন্দ্রভূমির মাঠ ঘাট পুকুর জলাশয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র ভূমির গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। গোদাগাড়ীর ললিতনগর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, আগে মানুষ খাওয়ার চিন্তা করতেন। এখন এলাকার মানুষের বড় চিন্তা হয়ে উঠেছে খাওয়ার পানি। পানির অভাবে এলাকাবাসী গরু ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অচল সেচ প্রকল্প
বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির অন্যতম উৎস পদ্মা নদী। কিন্তু এর বুকজুড়ে কেবল চরেরই বিস্তার ঘটে চলেছে। ফারাক্কাসহ উজানে অসংখ্য প্রকল্প করে একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে এই সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার সঙ্গে এর প্রশস্ততাও হ্রাস পেয়ে এটি মরা খালে পরিণত হয়ে পড়ছে। এর ফলে পানির নাগাল না পেয়ে নদীকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো মার খাচ্ছে। দক্ষিণের গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প পড়েছে করুণ দশায়। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের সব কটি পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। এই প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কৃষকদের সেচের পানি দেয়া হতো। সর্বশেষ চার উপজেলায় একটি পাম্পের সাহায্যে পানি সরবরাহ চালু ছিল। সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বোরো ধানের চারা রোপণের এই সময় এক লাখের বেশি কৃষক বিপদে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এতে ধান উৎপাদনে খরচ ১২ থেকে ১৫ গুণ বেড়ে গেছে।

https://www.dailysangram.info/post/554170