২১ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১২:২০

ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন, পিটিয়ে হত্যা

‘মারেন কেন আমরা তো দোষ করিনি’

আমরা অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিলাম আমরা আগুন লাগাইনি, আমরা দোষী না। আমরা যতই নির্দোষ দাবি করছিলাম ততই আমাদের ওপর নির্যাতন বেড়েই চলছিল। কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পঞ্চম তলার সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকা নান্নু মণ্ডল। তিনি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে স্থানীয়দের পিটুনিতে আহত হন। পিটুনিতে দুই শ্রমিক ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত অবস্থায় ৭ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় মন্দিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই শ্রমিকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের পিটুনির শিকার হন। এ ঘটনায় এলাকায় উচ্চ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। তিনি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।

হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পৃথক মামলা হয়েছে। মন্দিরে আগুনের ঘটনায়ও মামলা করা হয়েছে।
মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে গিয়ে জানা যায়, গত ১৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এলাকার বারোয়ারী কালী মন্দিরে পূজা দিচ্ছিলেন পাশের বাড়ির তপতি মণ্ডল নামের এক গৃহবধূ। মন্দিরটিতে তিনি প্রতিদিন একই সময়ে একাই পূজা-অর্চনা করেন। ওইদিন পূজা দেয়া শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখছিলেন মন্দির সংলগ্ন পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের শ্রমিকরা ভবনের ছাদে রড তুলছিলেন। তিনি বাড়ি যেতে না যেতেই মন্দিরে আগুন লাগার খবর শুনে এসে দেখেন কালীর কাপড়ে আগুন। আগুনের খবর পেয়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দা সেখানে জড়ো হন। শ্রমিকরা মন্দিরে আগুন দিয়েছেন এমন সন্দেহ থেকে একজোট হয়ে বিদ্যালয়ে থাকা ৯ শ্রমিককে তালাবদ্ধ করে ফেলেন। তারপর তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। নির্যাতনে ঘটনাস্থলেই দুই শ্রমিক পার্শ্ববর্তী এলাকা নওপাড়ার শাজাহানের দুই ছেলে আশরাফুল ও আরশাদুল মারা যায়। নির্যাতনে গুরুতর আহত হন অন্য শ্রমিকরা। স্থানীয়রা নিহত ও আহতদের ৬ ঘণ্টা ওই রুমে তালাবদ্ধ করে রাখেন।

এসময় ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সেখান থেকে তিনি পুলিশকে খবর দেন। মধুখালী থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জেলা পুলিশকে অবহিত করে। পরে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার, পুলিশ সুপার মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

শুক্রবার সকালে এলাকাটিতে এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। পরিদর্শনে আসেন ডিআইজি মারুফ হোসেন। বিকালে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনকে আটক করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম বলতে চাইছে না পুলিশ।

শনিবার সকালে ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ধর্ম সচিব মোহাম্মাদ আবদুল হামিদ জমাদ্দারকে নিয়ে নিহত দুই সহোদরের পিতামাতার প্রতি সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়ি মধুখালী উপজেলার নওপাড়া যান। সেখানে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং নিহতদের কবর জিয়ারত করেন। পরে ঘটনাস্থল পঞ্চপল্লী কালী মন্দির পরিদর্শন করেন।

মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, কে কাকে মেরেছে তা এখন আমরা বলতে পারছি না। ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যেও হতে পারে। যাইহোক পরিবেশ শান্ত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, দুটি প্রাণ ঝরে গেল জেনেও ছয় ঘণ্টা একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখাটা নিন্দনীয়। আমি এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলতে চাই এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

পুলিশ সূত্র জানায়, এ ঘটনায় নিহতের পিতা শাজাহান বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন, মধুখালী থানার এসআই শংকর কুমার পুলিশ অ্যাসল্ট ঘটনায় আরও একটি মামলা করেছেন। মন্দিরে আগুনের ঘটনায়ও একটি মামলা হয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=106442