২১ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১২:০৮

ব্যাংকের একীভূতকরণ

আতঙ্কিত আমানতকারী ও ব্যাংকাররা পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক

হঠাৎ আমানত প্রত্যাহারের চাপ বেড়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কাজের স্পৃহা কমে গেছে। অনেকেই আতঙ্কিত। এটা চলতে থাকলে আর্থিকভিত্তি দুর্বল থেকে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সাম্প্রতিককালে সবলের সাথে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে সংবাদ বের হওয়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, একীভূত হওয়ার তথ্য গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাংকের বড় বড় আমানতকারীরা চিঠি দিয়ে তাদের টাকা তুলে নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। এতে আমাদের তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এক দিকে, আমানতকারীদের চাপ অপর দিকে প্রভাবশালী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপ সব মিলেই বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থান থেকে সরে আসছে। ইতোমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে, নতুন করে আর কোনো দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করা হবে না। সংস্থাটি বলেছে, যেগুলোর বিষয়ে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ওইগুলোর ফলাফল দেখে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে যে নীতিমালা দেয়া হয়েছিল আর বাস্তবে যা করা হচ্ছে তার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেবে। ‘বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’য় বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংককে ২০২৫ সাল থেকে বাধ্যতামূলক একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এ কাজের খরচ জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি গাইড লাইন দিয়েছে। বিভিন্ন আর্থিক সূচকের মানদণ্ড শর্তানুযায়ী পূরণ না করতে পারলে ব্যাংকটি দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হয়েছে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। অর্থাৎ ২০২৫ মার্চের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু ইতোমধ্যে যে ১০টি ব্যাংক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দুটি ব্যাংক ছাড়া অন্য ৮টি ব্যাংক নিজেদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেকটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আর এ জন্য ইতোমধ্যে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক তাদের পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা আপাতত বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সাথে মার্জারে যাবে না। ইতোমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে যে তথ্য বের হয়েছে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সাথে একীভূত হবে সে বিষয়েও তারা আগাম কিছু জানেন না।

এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু মোহাম্মদ মোফাজ্জল গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংক একটি শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক। আমানতকারীদের সরকারি ব্যাংক হিসেবেই বেসিক ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন। এখন, সংবাদমাধ্যমে তথ্য বের হয়েছে, বেসিক ব্যাংক বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সাথে মার্জ হয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো বেসিক ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংক হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে অনেক আমানতকারী সরকারি বেসিক ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। এটা করা হলে ব্যাংকটি আরো সঙ্কটের মুখে পড়বে। যেহেতু বেসিক ব্যাংকের মালিক সরকার তাই পর্ষদ সভায় এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে সরকারকেই জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ মহলে তা অবহিত করা হয়েছে। এখন সরকারই এর সিদ্ধান্ত নেবে।

অপর দিকে অন্য যেসব দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার তথ্য বের হয়েছে তারাও একই সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এক দিকে আমানতকারীদের চাপ অপর দিকে প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকদের চাপ সবমিলেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আপাতত পিছে হঠতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। কারণ, জবরদস্তি একীভূত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে আগামী বছরের মার্চের পর। কিন্তু এখনই কিছু ব্যাংকের ওপর জবরদস্তি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ায় বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ কারণেই সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাওয়া ১০ ব্যাংকের বাইরে নতুন করে আর কোনো ব্যাংক একীভূত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১০ ব্যাংক একীভূত করার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে একীভূত করার প্রয়োজন দেখা দিলে তখন ভাবা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, ব্যাংক মার্জারের আমরা সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি প্রপোজাল পেয়েছি। আপাতত এই প্রস্তাবগুলোর বাইরে আর নতুন কোনো প্রস্তাব আমরা নেব না। এই পাঁচটি প্রস্তাবের ব্যাংকগুলো একীভূত করার পরে প্রয়োজন হলে নতুন মার্জারে যাওয়া হবে। এগুলোর প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে কোনো ব্যাংক মার্জার করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক একীভূত করতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অডিটর নিয়োগ, সম্পদ ও দায় ঠিক করা, শেয়ার দর ঠিক করা, শেয়ার অংশ নির্ধারণ ও আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। এই পাঁচ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অভিজ্ঞতা নেবো, অভিজ্ঞাতারও প্রয়োজন আছে। তার পর দেখা যাবে। সাধারণত দুটি ব্যাংক একীভূত করার সব ধরনের প্রস্তুতি ও আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে তিন-থেকে চার বছর লেগে যেতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/829363