১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৪৭

ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে ও দাবদাহে ওষ্ঠাগত প্রাণ

একদিকে প্রচন্ড দাবদাহ অন্যদিকে ভয়াবহ লোড শেডিংয়ে জনজীবনে চরম ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ফের বাড়তে শুরু করেছে লোডশেডিং। একদিকে বৈশাখের কাঠফাটা রোদের ভ্যাপসা গরম, অন্যদিকে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ মানুষের জীবন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কিছু এলাকায় লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেলেও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এটিকে লোডশেডিং না বলে কারিগরি ত্রুটি বলছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ভয়াবহ লোড শেডিংয়ের খবর।

গত ১৫ এপ্রিল থেকে অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা খোলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বাড়তে শুরু করে লোডশেডিং। তবে মেরামতে থাকা এলএনজি টার্মিনালটি পুনরায় চালু হওয়ায় ঈদের আগের তুলনায় বর্তমানে গ্যাসসংকট পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে, তার পরও ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।

দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। আরইবির জোনভিত্তিক বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে এই বিতরণ কোম্পানিকে ৯৪৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এই সময় সারা দেশে কোম্পানিটির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল আট হাজার ১৬১ মেগাওয়াট, সরবরাহ করা হয়েছে সাত হাজার ২১৫ মেগাওয়াট। একই সময় আরইবির বিতরণ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

আরইবির এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ দিচ্ছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। যে কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে চাহিদা কম থাকায় আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা দিতে পেরেছি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকেল ৩টার সময় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৫৯১ মেগাওয়াট। তখন লোডশেডিং করতে হয় ৫৮২ মেগাওয়াট।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিজিসিবি দৈনিক প্রতিবেদনে যে বিদ্যুতের চাহিদা ও লোডশেডিং চিত্র দেখাচ্ছে, বর্তমানে তার চেয়ে চাহিদা ও লোডশেডিং প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বেশি।

বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দিন ধরে অস্বাভাবিক হারে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। ফলে উৎপাদনও বাড়ানো হয়েছে। তার পরও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। দিনের বেলা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়িয়ে সাত হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কয়লা থেকেও তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।

রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এসির ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদাও বেড়েছে। তার পরও আমরা চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছি। কারিগরি ত্রুটির কারণে আমাদের বিতরণ কিছু এলাকায় স্বল্প সময়ের জন্য বিভ্রাট হতে পারে। তবে কোনো লোডশেডিং নেই।’

সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় তীব্র গরমে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচকাজ। এই জেলার সাতটি উপজেলায় একই চিত্র রয়েছে। জুড়ী উপজেলার বাসিন্দা জালাল আহমদ বলেন, ‘প্রচন্ড গরমের মধ্যে দিনে-রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না। গত কয়েক দিন ধরে বিদ্যুৎ আধাঘণ্টা পর পর চলে যায়, এতে খুবই দুর্ভোগে আছি আমরা।’

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ভ্যাপসা গরমের মধ্যে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েকবার লোডশেডিং হয়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একদিকে প্রচন্ড গরম শুরু হয়েছে, অন্যদিকে দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। তবে ঈদের আগে লোডশেডিংয়ের অবস্থা আরো বেশি খারাপ ছিল।

বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র বলছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। ৪ দিন ধরে উৎপাদিত হচ্ছে ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। চাহিদা থাকছে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার। ফলে লোডশেডিং থাকছেই। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে
ঈদের ছুটির শেষ দিকে গরম বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে। তবে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ ও জ্বালানি কিনতে ডলার ও টাকার ঘাটতিতে আছে বিদ্যুৎ বিভাগ। জরুরি ভিত্তিতে ডলার ও ভর্তুকির টাকা ছাড় করতে অর্থ বিভাগকে অনুরোধ করেছে তারা।

দেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। কয়লা থেকে প্রায় পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন করা হচ্ছে।

পিডিবির সদস্য খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে এলএনজি টার্মিনাল চালু হতে পারে। এতে আমদানি করা গ্যাস সরবরাহ বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। তিনি বলেন, ঈদের ছুটির সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে।

বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট।

গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহের গ্রামগুলোতে দিনে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর একজন কর্মকর্তা বলেন, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রায় ২৪ শতাংশ লোডশেডিং ছিল। ঈদের ছুটির সময় গরম বেশি থাকলে লোডশেডিং হতে পারে। আর ময়মনসিংহ পিডিবি বলছে, চাহিদা ২৭৮ মেগাওয়াট, পাওয়া গেছে ২৩৩ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৪৫ মেগাওয়াট।

লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে নান্দাইলে মানববন্ধন হয়েছে। স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক বিপ্লব চন্দ্র সরকার বলেন, চাহিদা ৩৫ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিংয়ের ব্যাপক ভোগান্তিতে রয়েছেন সুনামগঞ্জ, কুমিল্লার ১৩টি উপজেলা এবং যশোরের বাসিন্দারাও।

নওগাঁয় এক সপ্তাহ ধরে গ্রামাঞ্চলে দিন-রাতে সাত থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। শহরাঞ্চলেও লোডশেডিং হচ্ছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। জেলার ধামইরহাট পৌরসভার টিঅ্যান্ডটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, দিন-রাত মিলিয়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।

নওগাঁ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় থাকা এলাকায় চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। নওগাঁ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর উপমহাব্যবস্থাপক রাজ্জাকুর রহমান বলেন, কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের ব্যাপক ভোগান্তিতে রয়েছেন সুনামগঞ্জ, কুমিল্লার ১৩টি উপজেলা এবং যশোরের বাসিন্দারাও।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বলারামপুর গ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ঈদ উপলক্ষে সন্তান নিয়ে গ্রামে এসেছেন। বেড়াতে এসে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়ছেন।

https://www.dailysangram.info/post/553959