১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৪৪

আমানতকারীর অর্থের সুরক্ষা না হলে ধস নামবে ব্যাংক ব্যবসায়

-ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, দেশের অর্থনীতি নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় সব দ্বিধা কেটে গেছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সংকট কেটে গেছে। যারা দেশে শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি হবে বলে ভেবেছিলেন, তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী তার অবস্থান থেকে এমন কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনি সাধারণ মানুষকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। অর্থনীতি নিয়ে কোনো ধরনের আশঙ্কার কারণ নেই। কিন্তু অর্থনীতিতে বিদ্যমান কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের ভাবনার বিষয় আছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও এ চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো জানেন।

অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। গত এক বছর আট মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার এক পর্যায়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা ছিল দেশটির বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটাতে পারিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। আগে যেখানে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, সেখানে এখন তা সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। ফলে পলিসি রেট বাড়ানোর কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। কিন্তু এতকিছুর পরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু বাজারে পণ্য সরবরাহ যদি না বাড়ে এবং বাজার যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমবে না। সার্বিকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের নয়; বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করার আছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এখনো কমে যাচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ ছিল, এখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, বাইরে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে কম।

কিন্তু চলে যাচ্ছে বেশি। আমাদের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান যখন কমে যায়, তখন তার প্রভাব ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। কারণ স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ভোক্তাকে আগের তুলনায় বেশি অর্থ দিয়ে পণ্য ক্রয় করতে হয়।

বিশ্বব্যাংক তার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এগুলো হচ্ছে-উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতের ঝুঁকি। সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করলেও বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

অর্থনীতিতে একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাত। এ খাতের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তুলনামূলক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। আগামীতে আরও কিছু ব্যাংক একীভূত করা হতে পারে। কিন্তু শুধু একীভূত করা হলেই ব্যাংক খাতের সব সমস্যার সমাধান হবে না।

দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ক্ষেত্রে বেশকিছু জটিল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একীভূতকরণের পর সবল ব্যাংকটিকে তো সবল রাখতে হবে। হয়তো দেখা গেল, দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর সবল ব্যাংকটিও দুর্বল হয়ে পড়ল। তাহলে এ উদ্যোগ সফল হবে না। পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অনেকে একে একীভূতকরণ না বলে অধিগ্রহণ বলতে চান। কিন্তু আমি মনে করি, এটিকে একীভূতকরণ বলা যেতে পারে। একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংক খাতের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
যেসব ব্যাংক দুর্বল, তার সবগুলোকে আপনি চাইলেই একীভূতকরণ করতে পারবেন না। তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এসব ব্যাংকে যারা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে, তাদের ঢালাওভাবে ছাঁটাই করে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে। যেসব কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে। অর্থাৎ এমন একটি বার্তা দিতে হবে যে, ব্যাংক খাতে চাকরি করতে হলে সৎভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় কোনোভাবেই চাকরি রক্ষা করা যাবে না। এটি করা হলে ব্যাংক খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।
দেশে ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখানে ৬১টি ব্যাংক ব্যবসা করছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে মাত্র ১৮/১৯টি ব্যাংক ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম, সেসময় রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকেই নতুন ব্যাংক স্থাপনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি একটি ব্যাংকও অনুমোদন দেইনি। পরে কী কারণে দেশে এতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো, আমি তা বুঝতে পারছি না।

আবার সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যক্তিমালিকানায় সর্বশেষ ৯টি ব্যাংকের অনুমোদনদানের সময় বলেছিলেন, দেশে আর ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলো। ব্যাংকের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনদানের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। ব্যাংক অনুমোদন দিতে হলে সৎ, যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা আমরা বেশ ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করছি।

সর্বশেষ যে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ভালোভাবে চলছে না। প্রতিটি ব্যাংককেই বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদনদানকালে উপযোগিতা বিবেচনা করা হয়নি। এর খেসারত এখন আমরা দিচ্ছি। এখন সময় এসেছে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের মাধ্যমে ব্যাংক একীভূতকরণ করা ঠিক হবে না। এজন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে এ প্রক্রিয়া নিয়ে কখনোই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে না পারে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাবস্থায় ২০০৮ সালে ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের ব্যাপারে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে এসেছিলাম। একীভূতকরণের পর দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাউকে দায়িত্বে বহাল রাখা ঠিক হবে না। একইসঙ্গে আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুস্পষ্ট
, আমানতকারীরা যদি তাদের আমানতকৃত অর্থের সুরক্ষা না পায়, তাহলে ব্যাংক ব্যবসায় ধস নামতে বাধ্য। দুর্বল ব্যাংকে যারা কর্মরত ছিলেন, তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা যাবে না। যদি কর্মকর্তা উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের ছাঁটাই করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় দুটি ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট আলাদা রাখতে হবে। পরবর্তীকালে কোনো এক সময় ব্যালেন্স শিট একত্রিত করা যেতে পারে। দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের দায়ভার কে নেবে? সবল ব্যাংকেরও তো খেলাপি ঋণ আছে। এক্ষেত্রে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের কথা বলা হচ্ছে।

এখনো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হয়নি। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এসব কাজ করা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কঠিন। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব দেশে ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয়েছে। বেলজিয়ামেও ব্যাংক একীভূতকরণ করা হয়েছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশকিছু ব্যাংক একীভূতকরণ করে ব্যাংক খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন করা হয়। কিন্তু বিডিবিএল তেমন কোনো সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। এ অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো যেতে পারে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে ব্যাংক একীভূতকরণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একীভূতকরণ করার জন্য উপযোগী নিয়ম-কানুন তৈরি করতে হবে। চট করে বা জোর করে ব্যাংক একীভূতকরণ করা ঠিক হবে না।

দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণভারে জর্জরিত হয়ে আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ কেউ তো এসে বলবে না আমি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা নানাভাবে নিজেদের ঋণখেলাপিমুক্ত দেখানোর চেষ্টা করবে। ঋণখেলাপি ঋণখেলাপিই।
এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত আর অনিচ্ছাকৃত আবার কী? যিনি ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করছেন না, তিনিই ঋণখেলাপি। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে তিনি কী কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। যেমন, কোনো কারখানায় যদি আগুন লাগে, তাহলে তার উদ্যোক্তা ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে না-ও পারেন। কেউ হয়তো ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিলেন; সেই ঋণের মধ্যে ৪ কোটি টাকা প্রকল্পে ব্যয় করলেন আর অবশিষ্ট ৬ কোটি টাকা দিয়ে গুলশানে বাড়ি ক্রয় করলেন। একে আপনি কী বলবেন? তিনি তো চুরি করার জন্যই ঋণ নিয়েছেন। সময় এসেছে ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সত্যিকারার্থেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের।

২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলিকরণের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা প্রয়োজন। আমি গভর্নর থাকাবস্থায় প্রথমবার ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলিকরণের জন্য ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। পরবর্তীকালে ২০ ও ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। ঋণ হিসাব তিন বছরের জন্য পুনঃতফশিলিকরণ করা যেত। ১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ২ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আপনি ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলিকরণ করে নিলেন, এটি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। পুনঃতফশিলিকৃত ঋণ হিসাবকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমাদের বিভিন্ন আইন আছে। কিন্তু আইন প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিদেশে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে তার ক্রেডিট রেটিং কমে যায়। ক্রেডিট রেটিং কমে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না। পেট্রোল পাম্পে তাকে পেট্রোল নিতে দেওয়া হয় না। তাদের জন্য বিদেশ ভ্রমণেও বাধা দেওয়া হয়। বাড়িভাড়া নিতে গেলেও ক্রেডিট কার্ড দেখতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশে এসব ব্যবস্থা নেই। আমি মনে করি, ঋণখেলাপিদের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা দরকার, যাতে একজন ঋণখেলাপি যেখানেই যাবেন, তিনি ধরা পড়বেন। তবে শুধু আইন দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আইন যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেজন্য আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। (অনুলিখন : এম এ খালেক)
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : অর্থনীতিবিদ; সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/796052