৯ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৫:০২

থাকছে উদ্বৃত্ত, তবু ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি কেন

কোরবানির ঈদের মাস দুয়েক আগে ব্রাজিল থেকে গরু আমদানির বিষয়টি খামারিদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। যদি কোরবানির আগে ব্রাজিলের গরু দেশে ঢোকে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারিরা।

লোকসানের আশঙ্কা করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে আমদানির প্রয়োজন নেই। বিদেশ থেকে গরু কিংবা মাংস আনা হলে গ্রামের সাধারণ কৃষকসহ প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদিত গরুর উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হবে। প্রয়োজনে উন্নত জাতের গরু এনে দেশে জাত উন্নয়ন করা যেতে পারে। তাতে বাংলাদেশ এক সময় মাংস রপ্তানি করতে পারবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে যে পরিমাণ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া আছে; তা কোরবানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। ২০০১-০২ সালে মাংস উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ টন। ১০ বছর পর ২০২১-২২ সালে প্রায় ১০ গুণ উৎপাদন হয়; ৯৩ লাখ টন। মোট মাংস উৎপাদনের একটি বড় অংশ (৪৯ দশমিক ৮১ শতাংশ) আসে গরু থেকে। যদিও গত ১০ বছরে গরুর সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫৬ শতাংশ। বর্তমানে মাথাপিছু মাংস গ্রহণ প্রায় ৫৫ কেজি, যা চাহিদার চেয়ে কিছুটা বেশি।
দেশে বছরে পৌনে ৩ কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে। এর প্রায় ৫০ শতাংশই জবাই হয় কোরবানির সময়। সেই হিসাবে কোরবানির সময় ১ কোটি ১৫ লাখের মতো গবাদি পশুর দরকার হয়। এ পরিমাণের চেয়ে বেশি গবাদি পশু দেশের খামারি ও গৃহস্থের ঘরে রয়েছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর বছর ২০২০ সাল থেকে কোরবানির পশু অবিক্রীত থাকায় পরিমাণ বেড়েছে। সেই থেকে প্রতি কোরবানিতে ২১ লাখের ওপর পশু অবিক্রীত থাকছে। গত কোরবানির ঈদেও প্রায় ২৫ লাখ পশু অবিক্রীত ছিল। এতে লোকসানের শিকার হয়ে অনেক খামারি এ পেশা থেকে সরে যান। সারা বছর দেশের খামারিরা যে আশায় গবাদি পশু লালন-পালন করেন, ঈদের আগে এভাবে গবাদি পশু আমদানি করলে খামারি ও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যাংক ঋণ নিয়ে লালন-পালন করা এসব পশুর ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষক ও খামারিরা ঋণগ্রস্ত হয়ে গবাদি পশু পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। ফলে এ শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের জনপ্রতি দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা হিসাবে বার্ষিক মাংসের চাহিদা ৭২ দশমিক ৯৭ লাখ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি থেকে মোট মাংস উৎপাদিত হয়েছে ৭৫ দশমিক ১৪ লাখ টন, অর্থাৎ ২ দশমিক ১৭ লাখ টন উদ্বৃত্ত।

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গবাদি পশু ও পোলট্রির সংখ্যা ছিল ৪৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৯ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজারে।

২০১৯ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বেঙ্গল মিটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গরুর মাংস রপ্তানি করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, কুয়েত, কানাডা, জাপান ও মালদ্বীপে প্রায় ৮২ টন মাংস রপ্তানি হয়।
বিশ্বজুড়ে গরুর মাংস আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ তালিকায় নেই। ২০১৮ সালে রপ্তানি হওয়া ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাংসের ৭২ শতাংশের ক্রেতাই ১৫ দেশের, যার বেশির ভাগই স্বল্পোন্নত ধনী দেশ। শীর্ষ ১৫ আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে– যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, জার্মানি, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, মিসর, চিলি ও তাইওয়ান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান কিছু গরুর মাংস আমদানি করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা কমে যায়। ওই সময় দেশের মাংসের চাহিদা মেটাতে সারাদেশে ছোট ছোট অনেক খামার গড়ে ওঠে। সরকারও গরু মোটাতাজাকরণ ও গাভি পালনে স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গরুর উৎপাদন বেড়েছে। এ অবস্থায় মাংস আমদানি শুরু হলে লোকসানে গরু পালন থেকে খামারিরা সরে যাবেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আমদানি না করেই দেশের বাজারে আরও কম দামে মাংস বিক্রি সম্ভব জানিয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, এ জন্য প্রয়োজন দানাদার জাতীয় খাবারের দাম কমানো।

পোলট্রি ও পশু খাদ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, করোনার আগে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ১৮ থেকে ২২ টাকা। করোনার পর এটা সর্বোচ্চ ৪২ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল, এখন দাম ৩৬ টাকা। আর সয়াবিন কেকের দাম করোনার আগে ছিল প্রতি কেজি ৫০-৫৪ টাকা। তার পর দাম সর্বোচ্চ হয় ৮৫ টাকা। এখন ৮০-৮২ টাকা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, আমরা মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত কোরবানির ঈদেই ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু অবিক্রীত রয়েছে। এতে এখনও লোকসানের বোঝা টানছেন খামারিরা। এ অবস্থায় গরু কিংবা মাংস আমদানির প্রয়োজন নেই।

এ ব্যাপারে কৃষিপণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী বলেন, আমাদের দেশে সম্প্রতি দাম বাড়ার কারণে মাংস আমদানির বিষয়টি সামনে এসেছে। তবে যা দেশে উৎপাদিত হয়, তা কোনোভাবেই আমদানি বা অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। এতে দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ ছোট-বড় খামারি এবং এর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেবে, যা জাতীয় উৎপাদনকে ব্যাহত করবে।

বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফিটা) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. গিয়াস উদ্দিন খান বলেন, করোনা এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিডের (খাদ্য) দাম বেড়েছে। বাড়ছে পশু খাদ্য উৎপাদনে অত্যাবশকীয় কাঁচামালের দামও। এ কারণে দেশে পোলট্রি মুরগি, ডিম, মাছ, দুধ ও মাংসের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে দাম বাড়ার অজুহাতে আমদানি করে ভোক্তাদের খাওয়াতে হবে, এটা ঠিক হবে না। যাতে করে পণ্যমূল্য কমে আসে সেই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তা না হলে আমাদের মধ্যে আমদানিনির্ভরতা তৈরি হবে। ফলে দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় খামার ও খামারিরা। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ও জাতীয় অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, কোরবানির ঈদের আগে ব্রাজিল থেকে গরু আমদানির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।‌ ব্রাজিলের মাংসও দরকার নেই, গরুরও দরকার নেই। আমরা ব্রাজিলের কাছ থেকে প্রযুক্তি সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ চাই।

এ ছাড়া উচ্চমূল্যের দানাদার খাবারের বদলে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত ও উচ্চ ফলনশীল সমৃদ্ধ ঘাস উৎপাদন, খামারিদের টেকনিক্যাল ট্রেনিং, চামড়ার দাম বাড়ানো, গো-হাটের খাজনা কমানো, ফার্মার মার্কেট তৈরি করার ওপর জোর দেন তিনি।

https://samakal.com/bangladesh/article/231827