৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১০:১৮

বিদেশি ঋণের চাপ ‘অসহনীয়’

বিদেশি ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি ঋণের চাপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ঋণ পরিশোধে অর্থ সংকটে রয়েছে সরকার। পুরোনো ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে নতুন ঋণ নিতে হচ্ছে। যা আগামীতে আরও সংকট তৈরি করবে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি না থাকলে পরিশোধ নিয়ে এত উদ্বেগ থাকত না। অথচ ঋণের তেমন প্রতিফলন নেই জনজীবনে। মাতৃমৃত্যু বৃদ্ধি, গড় আয়ু কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে আর্থসামাজিক উন্নয়নেও তেমন কোনো অবদান নেই এসব ঋণের। বরং ব্যক্তি খাতের বিদেশি ঋণের অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যা এক ধরনের প্রতারণামূলক বাস্তবতা।

‘বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ এবং পরিশোধের সক্ষমতা’ শিরোনামের এক সংলাপে গতকাল বৃহস্পতিবার এমন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি এ সংলাপের আয়োজন করে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় রাজধানীর হোটেল লেকশোরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। সংলাপ সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং ব্যবহারের কার্যকারিতার অভাব প্রসঙ্গে বিভিন্ন সমালোচনার জবাবে ড. মসিউর রহমান বলেন, বিদেশি ঋণ দরকার। তবে ব্যয়ের বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। মান এবং ব্যয়ের বিষয়ে আরও খেয়াল করতে হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় মূল্যায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। সুতরাং, বেশি ব্যয় কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয়। বড় প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নে রাশিয়া ছাড়া আর কেউ ঋণ দিতে রাজি হয়নি। এ প্রকল্পটিতে ঋণের বিপরীতে সুদের হার শুরুতেও ৫ শতাংশ ছিল। এখনও একই হার বহাল আছে।

আলোচনায় সিপিডির চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান বলেন, স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের কারণে বিপজ্জনক পথে রয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলংকা এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ঋণের সুবিধা সে দেশের সেবা খাতে যথার্থভাবে যুক্ত হয়নি। বাংলাদেশেও এমন ঋণ বাড়ছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে ভালো অবস্থানে ছিল। কারণ তখন এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি ঋণের বিষয় ছিল না। যা এখন দ্রুত বাড়ছে। প্রশাসনিক অদক্ষতা প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান বলেন, ঋণসংক্রান্ত আলোচনায় অদক্ষতা এবং দুর্নীতির বিষয় রয়েছে। মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে। যা ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ঋণকে পুঁজিতে পরিণত করতে এ পর্যন্ত তেমন কিছু করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশি ঋণের ফাঁদ নিয়ে কথা হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতি এড়াতে ঋণ নেওয়ার আগেই খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত ছিল, এসব ঋণের আসলে প্রয়োজন ছিল কিনা। মানসম্পন্ন ব্যবহার করতে পারা যাবে কিনা। এ কারণে বিদেশি ঋণের অনেক অপচয় হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি শ্রীলংকার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, নীতির দুর্বলতা এখানে বড় বিষয়। এ দুর্বলতা দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। শুধু কথাই বলা হবে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত বছরগুলোতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে। ফলে খাতভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ঋণের মাধ্যমে উন্নয়ন জনজীবনে প্রতিফলিতই যদি না হয়, তাহলে অর্থ গেল কোথায়। বিদেশি ঋণের প্রবাহ এবং মানসম্পন্ন ব্যবহারের সংকটের কারণে ঋণ পরিশোধের বোঝার এ রকম অসহনীয় পরিণাম সম্পর্কে দুই বছর আগেই সিপিডির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছিল, ২০২৪ সাল ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি কঠিন হবে। দায়দেনা পরিশোধে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। ২০২৫ সাল থেকে ঋণ পরিশোধে অস্বস্তি শুরু হবে। ২০২৬ সালে তা আরও প্রকট হবে। তিনি বলেন, দায়দেনার হিসাবে গাফলতি আছে। অনেক কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয় না। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়াবে। আজ যারা ২০ থেকে ২৫ বছরের বয়সসীমায় রয়েছে, তারাই এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, মেগা প্রকল্প থেকে একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে। গত দেড় দশকে ঋণ করে অনেক মেগা প্রকল্প করেছে সরকার। তা সবার উন্নতিতে কাজে আসেনি। বরং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। ঋণ বাড়লেও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়নি। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তিনি বলেন, মোট বিদেশি ঋণের ৮০ শতাংশ সরকারি বাকি ২০ শতাংশ ব্যক্তি খাতের ঋণ। ব্যক্তি খাতের ঋণ কেউ কেউ বিদেশে নিয়ে গেছেন।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পকে একটা পয়সাও ব্যয় করা যাচ্ছে না। আমরা প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে রয়েছি। অথচ বিদেশি ঋণ পরিশোধে সংকটকে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অস্বীকারের মনোভাব দেখা গেছে। যারা নীতিনির্ধারণ করেন, তারা বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে পারেন না। এ কারণে পেশাদার বিশ্লেষকদের তারা ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদুর রহমান বলেন, ঋণ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি না থাকলে পরিশোধ নিয়ে আজ এত বড় উদ্বেগের কারণ হতো না। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিদেশি ঋণে অনেক বড় প্রকল্প নেওয়া হয়, অথচ দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং ব্যবহারে দুর্নীতি আছে, স্বচ্ছতা নেই।

সংলাপে বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ঋণ ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে। অথচ সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না। ফলে ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে সরকারকে নতুন করে ঋণ নিতে হচ্ছে। পাবলিকলি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ পরিশোধের জন্য ঋণ নিচ্ছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বর্তমানে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিদেশি ঋণের ধরনের পরিবর্তন প্রসঙ্গে প্রবন্ধে বলা হয়, মোট ঋণে রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, বাড়ছে বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্ত আরও কঠোর হচ্ছে। বিশেষত জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা যে হারে বাড়ছে, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঋণ ব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সময় যত কমে আসছে, ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বিষয়টি। কারণ উত্তরণের পর আর বর্তমানের মতো নমনীয় সুদের হারে বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে না। এখন সতর্ক হওয়া এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

https://samakal.com/economics/article/231254