৪ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৪:৩৯

ঘোষণা দিয়ে তিন ব্যাংকে লুট

বান্দরবানে অনেকটা পূর্ব ঘোষণা দিয়েই ফিল্মি স্টাইলে সিরিজ ব্যাংক ডাকাতি, লুটপাট ও তাণ্ডব চালিয়েছে নতুন সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ২৪ ঘণ্টায় রুমা ও থানচি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের দুটি ও কৃষি ব্যাংকের একটি শাখায় হামলা ও লুটপাট চালায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ভল্টের চাবি না দেয়ায় শাখা ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে তারা। ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে নিরাপত্তা রক্ষীদের ১৪টি অস্ত্র ও ১৭ লক্ষাধিক টাকা লুট করেছে। মারধর করেছে পাশের মসজিদের মসুল্লিদেরও। তাণ্ডব চালিয়েছে আশপাশের দোকানেও। লুটপাটের পর ফাঁকা গুলি ছুড়ে চাঁদের গাড়িতে করে পালিয়ে যায় তারা। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকের সব শাখার লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সদর ছাড়া আজ বৃহস্পতিবারও বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকের সব শাখার লেনদেন বন্ধ থাকবে। এদিকে রুমা শাখা সোনালী ব্যাংকের ভল্টে থাকা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির কর্মকর্তারা।

চাবি না দেয়ার কারণে ভল্টের তালা খুলতে না পারায় এ টাকা নিতে পারেনি সন্ত্রাসীরা। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছিলেন সন্ত্রাসীরা ভল্ট খুলে টাকা লুট করেছে।

এদিকে বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে গত মঙ্গলবার টাকা লুটের ঘটনায় পরিদর্শন করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, থানচিতে দুটি ব্যাংকে হামলার ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আমরা সব সমন্বয় করে কাজ করছি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে কেএনএফের ৭০-৮০ জন সশস্ত্র সদস্য রুমা উপজেলা পরিষদ এলাকা ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে পাহারারত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং মারধর করতে থাকে। ব্যাংকে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। একপর্যায়ে ব্যাংকের ভল্ট খোলার জন্য পাশের মসজিদে নামাজরত শাখা ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে ধরে নিয়ে আসে। কিন্তু ভল্টের চাবি না দেয়ায় নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।

ব্যাংক লুটের সময় পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, মঙ্গলবার ৮টা ২০ মিনিটের দিকে ব্যাংকে হামলা হয়েছে। এই হামলার সময় পুলিশের যে গার্ডরা রয়েছে তাদের ১০টা অস্ত্র ছিল। আটটা চাইনিজ রাইফেল, দুইটা এসএমজি। তাদের ৩৮০ রাউন্ড গুলি লুট হয়েছে। এ ছাড়া আনসারের চারটি শর্টগান ও ৩৪ রাউন্ড গুলিও লুট করে নিয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তাণ্ডকর্মচারীসহ সাধারণ জনগণের নিরাপত্তায় পুলিশ সদস্য সংখ্যা বাড়িয়েছে। সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলা পরিষদ মসজিদে নামাজে ছিলেন ব্যাংক ম্যানেজার। সেখানে উপজেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও ছিলেন। ফরজ নামাজ পড়ার পর সন্ত্রাসীরা মসজিদে প্রবেশ করে মুসল্লিদের মারধর শুরু করে। তারা টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তারা ব্যাংক ম্যানেজারকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায়।

এদিকে রুমার পর বুধবার দুপুরে থানচি উপজেলা সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে থানচি সদরের শাহজাহানপুরের দিক থেকে তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাজার এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর থানচি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে নগদ টাকা যা পেয়েছে তা নিয়ে চলে যায়। থানচি থানা থেকে ব্যাংক দুটির দূরত্ব ২০০ গজ। উপজেলা পরিষদের দূরত্ব ৩০০ গজ। থানার কাছে দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনায় স্থানীয় লোকজন হতভম্ব। সোনালী ব্যাংক থানচি শাখার ব্যবস্থাপক ফয়সাল হুদা বলেন, অস্ত্রধারী পাঁচ থেকে সাতজন লোক ব্যাংকে ঢুকে। ক্যাশিয়ার সামনে পাওয়া সব টাকা তারা নিয়ে নেয়। আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা হতে পারে। ব্যাংকের বাইরে অস্ত্রধারী ১০ থেকে ১২ জন ছিল। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়।

সোনালী ব্যাংকের পাশে কৃষি ব্যাংক থানচি শাখার ব্যবস্থাপক হ্লা শৈ থোয়াই বলেন, ব্যাংকে চার থেকে পাঁচজন অস্ত্রধারী ঢুকে ক্যাশিয়ারের সামনে থাকা আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায়। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মহম্মদ আরমান বলেন, তিনি সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যান। বের হওয়ার সময় দেখেন অস্ত্রধারী লোকজন ব্যাংকে ঢুকছে। তারা ক্যাশিয়ারের সামনে থেকে টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এদিকে রুমা সোনালী ব্যাংকে সন্ত্রাসী হামলা ও লুটপাটের ঘটনার তদন্তে কক্সবাজার থেকে পিবিআইয়ের পাঁচ সদস্যের একটি টিম রুমা পরিদর্শন করেছে। বুধবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান, বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. সৈকত শাহীন। তারা সোনালী ব্যাংকটির ভল্ট দেখেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন পরিদর্শন শেষে বলেন, পিবিআই ও ব্যাংকের তদন্ত টিমের কাজ শেষে বলা যাবে ভল্ট থেকে টাকা খোয়া গেছে কিনা। এদিকে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। তাকে উদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকটি টিম অভিযান পরিচালনা করছে এলাকায়।

এদিকে বুধবার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। সিআইডি’র চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দুটি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুনে দেখা হয়। দেখা যায়, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা রয়েছে। অবশ্য থানচিতে দুটি ব্যাংকের শাখা থেকে অস্ত্রধারীরা সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে বলে জানান ব্যাংক দুটির শাখা কর্মকর্তারা।

কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে ৫ই মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেলপাড়ায়।

তিন সপ্তাহ আগে ফেসবুকে ‘বদলা নেয়ার’ ঘোষণা কেএনএফের: ওদিকে ব্যাংকে হামলার তিন সপ্তাহ আগে এক ফেসবুক পেজ থেকে ‘বদলা নেয়ার’ ঘোষণা দেয় পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের দুই সদস্যকে আটকের ‘ফিডব্যাক’ হিসেবে তারা এ ঘোষণা দিয়েছিল। ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি- কেএনএ’ নামের এক ফেসবুক পেজ থেকে গত ১২ই মার্চ এক পোস্ট করা হয়। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চুক্তি ভঙ্গ করে বম সম্প্রদায়ের নিরীহ জনগণ লালমুয়ানওম বম (গিলগাল বা অবচলিত পাড়া) এবং রামনুয়াম বমকে (দুনিবার পাড়া) আটক করেছে। এর ফল খুব সুন্দরভাবে ফিডব্যাক দেয়া হবে। নিরীহ জনগণকে হয়রানি বন্ধ করা না হলে।’ সংগঠনটির ইনফরমেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন ফ্লেমিংয়ের বরাতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনটির এ ঘোষণার ২১ দিনের মাথায় গতকাল বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলার ঘটনা ঘটে।

বান্দরবানের সব উপজেলায় বন্ধ সোনালী ব্যাংক: নিরাপত্তাজনিত কারণে বান্দরবান সদর শাখা ছাড়া থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগীয় কার্যালয়ের জেনারেল ম্যানেজার মো. মোসা খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার ও বুধবারের ঘটনায় নিরাপত্তাজনিত কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বান্দরবানের সদর শাখা ছাড়া সব উপজেলার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবারও সদর উপজেলা ছাড়া বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকের বাকি শাখার লেনদেন বন্ধ থাকবে।

নিরাপত্তার দাবিতে এলাকাবাসীর মানববন্ধন: এদিকে পার্বত‌্য এলাকার সকল নাগ‌রি‌কের নিরাপত্তা নি‌শ্চিত কর‌তে এবং ব্যাংক ডাকা‌তি ও সরকা‌রি অস্ত্র লুট এবং ব্যাংক ম‌্যা‌নেজার‌কে অপহরণের প্রতিবা‌দে বি‌ক্ষোভ সমা‌বেশ ক‌রে‌ছে পার্বত‌্য চট্টগ্রাম নাগ‌রিক প‌রিষদ। বুধবার সকাল ১১টায় বান্দরবান মুক্ত ম‌ঞ্চে এ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পার্বত‌্য চট্টগ্রাম নাগ‌রিক প‌রিষ‌দ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমা‌র। এসময় পার্বত‌্য চট্টগ্রাম নাগ‌রিক পরিষদ সহ-সভাপতি আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক নাছিরুল আলম বক্তব্য রাখেন।

https://mzamin.com/news.php?news=104587