১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:৪৯

কৃষি বিপণন অধিদফতরের ব্যর্থতায় ভুগছেন কৃষক ও ভোক্তা

ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ে কৃষিপণ্যের

‘কয়েক দিন বেগুন ৪-৫ টাকা কেজি বেচ্ছি। এরপর ১-২ টাকা হয়। হাটে-বাজারে নিলে নেয় না। ফাইল্যা (ফেলে) দিয়ে আসতে অয়। তাই কি করমু। বেগুন ক্ষেত কাইট্যা ফালাইলাম। বেগুনে লস তো খাইলাম। এহন তিল বুনমু’। কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার কয়ড়া রতন দিয়াড় গ্রামের সাইদুল ইসলাম। ক্ষুদ্র এ চাষি এবার আধা বিঘা জমিতে বেগুন আবাদ করেছিলেন। কিন্তু দাম না পাওয়ায় গাছ উপড়ে ফেলেছেন। বেগুন চাষে কি পরিমাণ খরচ হয়েছে, তার সঠিক হিসাব তার কাছে নেই। তবে তিনি বলেন, ‘খরচ তো অনেক অয়। ওষুধ দিতে অয়, সার দিতে অয়, সব সময় যত্ম নিতে অয়। হেই কার্তিক মাসে বেগুন লাগাইছিলাম। ক্ষেত থেকে কখনো সরতে পারি নাই। সবসময় যতœ নিতে অইছে। হিসাব করলে অনেক ট্যাহা খরচ। কি করমু, দাম তো পাইলাম না।
শুধু সাইদুল ইসলাম নয়, স্থানীয় অনেকেই বেগুন চাষ করে লোকসান গুনেছেন। দাম না পেয়ে হা-হুতাস করছেন অনেক ক্ষুদ্র কৃষক। অথচ প্রথম রমজানে ১২০ টাকা কেজি বেগুন খেতে হয়েছে ঢাকাবাসীকে।

শুধু যে বেগুন চাষে কৃষক লোকসান গুনছেন, তা নয়। সর্বশেষ তরমুজ আবাদ করে লোকসান দেয়ার পথে কৃষক। রোজা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকে কাঁচা বা আধা পাকা তরমুজ ক্ষেত থেকে তুলেই বাজারজাত করতে থাকে একটি চক্র। ৯০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে রাজধানীতে। এতে কৃষক যতটা না লাভবান হয়েছেন তার চেয়ে ক্ষতির মুখেই পড়েছেন বেশি। কারণ ওই তরমুজের দাম এখন এমনভাবে কমতে শুরু করেছে যে, কৃষক এখন দামই পাচ্ছে না। চৈত্রের তপ্ত গরমে তরমুজের চাহিদা বাড়লেও উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তা কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বেশি দাম হওয়ায় সামাজিকমাধ্যমে প্রতিবাদী হন অনেকে। তরমুজ না কেনার শপথও নেন অনেকে। অন্য দিকে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে তরমুজ কিনে বেশি লাভের আশায় মজুদ করে রাখেন ব্যবসায়ী/মধ্যস্বত্বভোগীরা। শেষ পর্যন্ত বেচতে না পারায় বিভিন্ন জায়গায় তরমুজ পচন ধরে। সেই পচা তরমুজ নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে এখন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি উৎপাদন বা সম্প্রসারণের দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই)। সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনজন করে কর্মকর্তা রয়েছে তাদের। সারা দেশে বিশাল এ জনবল নিয়ে খাদ্যশস্যসহ সব ধরনের ফসল সম্প্রসারণের কাজ করেন কৃষিবিদদের নেতৃত্বে ডিএই। ডিএইসহ বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে এ উৎপাদন প্রায় ৪ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার টনে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। মানুষ বাড়ায় মাথাপিছু জমির পরিমাণ ২৮ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশে নেমেছে। দেশে প্রতি বছর কৃষি জমি ০.৫৪ শতাংশ হারে কমছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ (বিনা) বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি বিজ্ঞানীরা উন্নতমানের ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার তা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। মাঠপর্যায়ে কৃষির সাফল্য অনেক। সরকারি হিসাবে দেশে চালের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। সবজি উৎপাদন চাহিদামতো হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে চালের চাহিদা ছিল তিন কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৬ লাখ টন। আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে এক কোটি চার লাখ টন। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও ভরা মৌসুমে চালের দাম ঊর্ধ্বগতি হয়। আলুর দাম তো মাঝখানে নাগালের বাইরে চলে যায়। এমন কী শীতকালেও সবজি কিনতে হয় উচ্চমূল্যে। এসবের পেছনে সবসময় দায়ি করা হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের। ক্রাইসিস শুরু হলে সরকার নড়েচড়ে বসে। অভিযান চালায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু কৃষিপণ্য বিপণনে দায়িত্বে থাকা কৃষি বিপণন অধিদফতর বরাবরই নির্লিপ্ত থাকছে। দিন শেষে বিভিন্ন পণ্যের কথিত বাজার দর বেঁধে দিয়েই দায় সারছেন কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি বাজার তদারকিতেও দেখা যায় না কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিষ্ঠানটিকে।

মূল্য তালিকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ : কৃষি বিপণন অধিদফতরের মূল লক্ষ্য হলো কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কৃষিপণ্যের গ্রেডিং, সর্টিং, প্যাকেজিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। মূল কার্যাবলি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃষি বিপণন তথ্য ব্যবস্থাপনা; কৃষিপণ্যের মূল্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; কৃষক ও কৃষিপণ্যের বাজার সংযোজন সৃষ্টি ও সুষ্ঠু সরবরাহের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান; কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং বিপণন ও ব্যবসা সম্পর্কিত অর্থনৈতিক গবেষণা পরিচালনা; কৃষিপণ্যের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ; সুষ্ঠু বিপণনের স্বার্থে কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় বাজার অবকাঠামো, গুদাম, হিমাগার, কুলচেম্বার ইত্যাদি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ এবং কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন। কৃষি বিপণন অধিদফতর তাদের ফেসবুক পেইজে এভাবে তাদের কার্যাবলি প্রচার করলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

কৃষিপণ্য বিপণন অধিদফতর কয়েক বছর ধরে যৌক্তিক মূল্যের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তবে ক্রেতা বা বিক্রেতা সেভাবে কেউ জানে না। মূল্য তালিকা বাজারে ‘দেখা যায়’ এমন স্থানে না টানানোয় কারো চোখে পড়ে না। সর্বশেষ গত ১০ রমজান হঠাৎই ২৯ কৃষিপণ্যের দাম বেঁধে দেয় অধিদফতর। পরের দিন দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে খবর আসতে শুরু করে, নির্ধারিত দামে কোথাও বিক্রি হচ্ছে না এসব পণ্য। দাম কার্যকরে কর্তা ব্যক্তিদের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত থাকা কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের কেউই বাজারে যান না বলে অভিযোগ ওঠে। বিচারিক ক্ষমতা নেই এমন অজুহাত দেখানো হলেও ঢাকায় বিভিন্ন তদারকি কাজে ম্যাজিস্ট্রেট বণ্টনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, গত সাত মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে কোনো চাহিদা পাইনি।

কৃষকের বাজার বন্ধ : কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কৃষি বিপণন অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও হরটেক্স ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউর সেচ ভবন চত্বরে চালু করে ‘কৃষকের বাজার’। টাটকা সবজি পেয়ে ক্রেতারা ছিলেন খুব খুশি। বেশ সাড়া ফেলে তখন। কৃষকের পণ্যে ভরে যেত সেচ ভবন চত্বর। পরে কৃষি মন্ত্রণালয় অস্থায়ী এ বাজারকে স্থায়ী ভবনে রূপ দেয়। গত বছরের ২৬ জুন মানিক মিয়া এভিনিউতে ৩৪টি দোকান নিয়ে স্থায়ী অবকাঠামো উদ্বোধন করেন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার। স্থায়ী কাঠামো হলেও সেই বাজার বন্ধ। গেটে ঝুলছে তালা। গত ১ সেপ্টেম্বর গাবতলী পশুহাটের পাশে কেন্দ্রীয় ফুল মার্কেট উদ্বোধন করেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক। ছয় মাস চলে গেলেও মার্কেট আগের মতোই ফাঁকা। দোকান বরাদ্দের কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি এখনো। কবে হবে, তাও কেউ জানে না। কৃষকের এই বাজার পরিচালনার দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদফতরের। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে চলছেন। একই অবস্থা দেশের জেলাপর্যায়ে করা কৃষকের বাজারেরও। গত রমজান থেকে রাজধানীতে কম দামে গরু, খাসি ও মুরগির গোশত, দুধ ডিম বিক্রি করছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। খামারিদের সহযোগিতায় ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বিক্রি হচ্ছে এ পণ্য। উদ্যোগটি বেশ সাড়া ফেলায় গত ২৭ মার্চ রাজধানীর ৫টি স্থানে কৃষকের দামে তরমুজ বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ এগ্রি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন। রাজধানীর খামারবাড়ি মোড়ে এ কার্যক্রম শুরুর পর তা পরিদর্শনে যান কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদ। প্রাইভেট সেক্টর এমন উদ্যোগ নিয়ে কৃষক ও ভোক্তাদের সুবিধা করে দিলেও সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদফতর কেন কৃষকের বাজার বন্ধ রেখেছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এটা কৃষি বিপণন অধিদফতরকেই জিজ্ঞেস করেন। বিষয়গুলো আমি জানি না, এখন জানলাম। সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সুরক্ষিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই কি শেষ কথা? উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ধরে নেয়া হলেও তা কি ভোক্তাদের পর্যাপ্ত ভোগের নিশ্চয়তা দেবে? উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ সমস্যার সমাধানে কোনো দীর্ঘকালীন পদক্ষেপ না নেয়া হলে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলাফল অংশীদারত্বমূলক হবে না, কৃষি অলাভজনক পেশা হিসেবেই বিবেচিত হতে থাকবে। কৃষির উৎপাদন বেড়েছে, মূল্য সংযোজন হয়েছে, তবুও কৃষি তুলনামূলকভাবে অলাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ কৃষক অনেক সময়ই তার উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক দাম পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে উভয়পক্ষই লাভবান হতে পারে। ফসল উৎপাদনে আগ্রহী এবং সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপ্রয়োজনীয় প্রভাব কমানো সম্ভব।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ করিমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/825638