৩১ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ১:১০

যা ইচ্ছা তাই করা হচ্ছে : আসিফ নজরুল : দেশটা কি মগের মুল্লুক?

-আসিফ আরসালান

নির্বাচন, কেয়ারটেকার সরকার ইত্যাদি নিয়ে বছরের পর বছর লিখে যাচ্ছি। একই বিষয় নিয়ে বিএনপির মতো দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলও অনেক সভা সমিতি করেছে যার মধ্যে কয়েকটি সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটেছিল। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী শুধুমাত্র সভা সমিতি, মিছিল মিটিং নয়, তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেককে জীবন দান পর্যন্ত করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেনি। বরং এই সময়ের সরকারের ভোকাল ক্রিটিক আমেরিকায় অধ্যাপনারত বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী ড. আলী রিয়াজ অনবরত লিখে যাচ্ছেন। তার লেখার বিষয়বস্তু বহুমুখী। প্রধান দুটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্য এবং গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে নির্বাসন দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কয়েক দিন আগে ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় ড. আলী রিয়াজ সর্বপ্রথম বলেছেন যে দলীয় স্বৈরতন্ত্র থেকে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্রের (চবৎংড়হধষরংবফ অঁঃড়পৎধপু) উত্থান ঘটেছে।

সমাবেশ এবং মিছিল যতই বড় হোক না কেন, দিন শেষে দেখা গেল, আওয়ামী সরকারের পতন ঘটানো যায়নি। মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিলেও সরকার টিকে গেল। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য বিরোধী দল কোথাও ক্ষীণতম প্রতিরোধও করতে পারলো না। কেন পারলো না? এসম্পর্কে একটি বিশেষ কথা আমার মনে পড়ছে।

প্রায় বছর খানিক আগে একজন গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদলীয় নেতা (বিএনপি বা জামায়াত নয়) অসুস্থ বেগম জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন। এটি তাদের ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ। যে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনিও কিন্তু মেডিকেল গ্রাউন্ডেই গিয়েছিলেন। তিনি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেন যে, বেগম জিয়া তাকে প্রথমে ২০ মিনিটের সময় দিলেও আলোচনা গড়াতে গড়াতে আধা ঘন্টা অতিবাহিত হয়। তখন ঐ বিরোধীদলীয় নেতা বলেন যে, ম্যাডাম, আমার নির্ধারিত সময় তো শেষ। তখন বেগম জিয়া ইনসিস্ট করেন, আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে। ঐ নেতা বেরিয়ে এলে সাংবাদিকরা তাকে ছেঁকে ধরেন। ঐ নেতা এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে সাংবাদিকদেরকে এড়িয়ে যান।

পরবর্তীকালে জানা যায় যে, বেগম জিয়া শুধুমাত্র ঐ নেতাকেই নয়, মির্জা ফখরুলসহ আরো কয়েকজনকে বলেছেন যে, তোমাদের আন্দোলন সফল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গণমানুষকে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং খেটে খাওয়া মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। ঘটনাচক্রে এই কলামিস্টের সাথে অনেকের কথা হয়েছে। তারাও ঐ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন যে, আন্দোলনে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ৭ই জানুয়ারি শেখ হাসিনা নির্বাচন ৫ শতাংশ ভোটে হলেও করে ফেলেছেন। সেটি ঠেকানো যায়নি। কারণ আইয়ুব আমলে এবং এরশাদের আমলে জনগণ যেভাবে পুলিশী বাধা অতিক্রম করে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তেমন ঘটনা এবার ঘটেনি। এই প্রতিনিধি বিএনপির অন্তত ৩ জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, নির্বাচনের দিন আপনারা কোথাও নির্বাচন প্রতিহত করতে পারলেন না কেন? তারা বলেছেন যে, শীর্ষ নেতা সহ আমরা ২৬ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে ছিলাম। রাস্তায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে কে? পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ২৮ অক্টোবর পুলিশের ঐ সাঁড়াশি অভিযানের পর আপনারা সাথে সাথে আত্মগোপন না করে ২৬ হাজার ব্যক্তি গ্রেফতার হলেন কেন?

॥ দুই ॥
এধরনের অনেক প্রশ্ন আছে। জবাবও আছে। একটি কথা ঠিক যে, এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র তো দূরের কথা, দলীয় স্বৈরতন্ত্রও নেই। বাংলাদেশে এখন যে শাসন চলছে সেটি হলো ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্র। মাত্র একজন ব্যক্তি দেশের প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার কেউ নেই। সুখের বিষয়, নির্বাচনের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিলম্বিত বোধদয় হয়েছে। এদের কয়েক জনেরই নাম করা যেতে পারে। ড. আলী রিয়াজের নাম তো কিছুক্ষণ আগেই বলেছি। এখন বলবো আরেকজন অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তির কথা। তিনি হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি টেলিভিশন টকশোতে এবং সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে তিনি অত্যন্ত চাঁচাছোলা কথা বলেছেন। এটিকে আমরা ইংরেজিতে বলতে পারি, ঐব যধং পধষষবফ ঃযব ংঢ়ধফব ধ ংঢ়ধফব. অর্থাৎ কোদালকে কোদাল বলা বা ঠোঁট কাটা ব্যক্তি। বিএনপি শাসনামলে আমরা দেখেছি বুদ্ধিজীবী নামধারী কিছু ব্যক্তি ১০ দিগন্ত থেকে সমস্বরে বিএনপি বিরোধী, বেগম জিয়া বিরোধী এবং মরহুম জিয়া বিরোধী ঐক্যতান তুলেছেন। ড. আসিফ নজরুল সাম্প্রতিক সময়ে চ্যানেল আইকে যা বলেছেন তার সংক্ষিপ্ত সার একটু পরে দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে বিএনপি নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো যে, গত ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি সভায় প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু বক্তব্য ও মন্তব্য। ভারতীয় পণ্য বর্জনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় পণ্য বর্জন, জেনারেল জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক তির্যক মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্যের কিছু অংশ নিচে তুলে ধরছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আরেকটি কথা না বলে পারছি না, দেখলাম বিএনপির এক নেতা চাদর খুলে আগুন দিচ্ছে ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করবে না। এরপর আবার দেখা গেল, কিছু চাদর কিনে এনে পোড়ানো হলো। আচ্ছা শীতকাল তো চলে গেছে। এখন আর চাদর পোড়ালে কী আসে-যায়। বিএনপি নেতাদের বলবো আপনাদের বউদের আলমারিতে যে কয়টা ভারতীয় শাড়ি আছে সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবেন সেদিন বিশ্বাস করব যে, আপনারা সত্যিকার ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন। আমাদের দেশে গরম মসলা, পেঁয়াজ, ভারত থেকে আসে। ভারত থেকে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করছি, রসুন-আদা, মিজোরাম থেকে আসে। আদা মসলাপাতি ভারত থেকে যা কিছু আসছে, তাদের কারও পাকের ঘরে যেন এই ভারতীয় মসলা দেখা না যায়। তাদের রান্না করে খেতে হবে এইসব মসলাবিহীন। কাজেই এটা তারা খেতে পারবেন কি না সেই জবাবটা তাদের দিতে হবে।

জিয়াউর রহমান একটা বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিল জিয়াউর রহমান। এই কথা নিশ্চয়ই তাদের ভুলে গেলে চলবে না। এটাও বললে চলবে না যে, স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন মেজর। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ যে আক্রমণ বাঙালির ওপর চালায়, সেই আক্রমণকারী একজন কিন্তু জিয়াউর রহমান। সেটা হলো চট্টগ্রামে। এটাও ভুললে চলবে না। জিয়াউর রহমান যে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হলো, এ প্রমোশনগুলো একে একে কে দিয়েছে? এটাও তো আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দিয়েছে। এই অকৃতজ্ঞরা সেটাও বোধ হয় ভুলে যায়।
তিনি আরো বলেন, জিয়াউর রহমানের জন্ম হলো কলকাতায়। ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়, তখন তারা কিন্তু পূর্ব বাংলায় আসেনি, তারা করাচিতে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেখানে পড়াশোনা করে। সেখানেই আর্মিতে যোগ দেয়। সেখান থেকে কার্যাদেশ করে সামরিক অফিসার হিসেবে পূর্ব বাংলায় এসেছিল দায়িত্ব পালন করতে। এটাই হলো বাস্তবতা। কিন্তু তার মনে তো পাকিস্তানটাই রয়ে গেছে। তার প্রমাণও আছে। তিনি বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম ২৬ মার্চ দুপুর ২টা-আড়াইটার সময় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি মান্নান সাহেব ঘোষণা দেওয়া শুরু করে। একে একে আমাদের যারা নেতা সবাই ঘোষণা পাঠ করে। সে সময় জহুর আহমেদ সাহেব বলেন, আমাদের একজন মিলিটারি লোক দরকার। তাহলে আমরা যে যুদ্ধ করছি, সেই যুদ্ধ যুদ্ধ হবে। তখন মেজর রফিককে বলা হয়, তিনি তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে আটকানোর জন্য অ্যাম্বুস করে বসে আছেন। বলছেন, আমি এখান থেকে নড়লে এই জায়গাটা ওরা দখল করে নেবে। ওই সময় জিয়াউর রহমানকে ধরে আনা হয় এবং তাকে দিয়ে ২৭ তারিখ সন্ধ্যার পরে সে জাতির পিতার পক্ষে ঘোষণাটা দেয়। পাঠ করে।

শেখ হাসিনা যখনই বিএনপি এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছু বলেন তখনই তিনি নতুন কিছু কথা বলেন। এবারও বলেছেন কিছু নতুন কথা। আমরা মনে করি, এসম্পর্কে বিএনপিকেও যথাযথ বক্তব্য দিতে হবে। বিএনপি যে বক্তব্য দেবে সেটা যেন ফ্যাকচুয়াল হয়, অর্থাৎ তথ্যনির্ভর হয়। এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি আসিফ নজরুলের কথায়।

॥ তিন ॥
আসিফ নজরুল যেসব কথা বলেছেন সেসব কথা নতুন নয়। কিন্তু যারা রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করেন তাদের জানা দরকার যে একই কথা বারবার বললে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। এতদিন পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে চওড়া সড়ক ছিল মানিক মিঞা এভিনিউ। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ইত্তেফাক কোনো স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা ছিল না। কিন্তু মানিক মিঞা সেখানে নিয়মিত একটি কলাম লিখতেন। কলামটির শিরোনাম, রাজনৈতিক মঞ্চ। লেখক মোসাফির। এই নামে মানিক মিঞা সাহেব কয়েক হাজার কলাম লিখেছেন। সবগুলোরই মূল কথা ছিল, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে। এটিকে বলা হতো অর্থনৈতিক বৈষম্য। আর একটি মূল সুর ছিল, পাকিস্তানে জনগণের শাসন কায়েম হয়নি। আইয়ুব খানের ১০ বছরের শাসনের উল্লেখ করা হতো বারবার।

মানিক মিঞা সাহেবের কলামে বিধৃত অভিযোগ বা বক্তব্যগুলো যে ভিত্তিহীন ছিল তা নয়। কিন্তু বছরের পর বছর তিনি এসব কথা বলায় হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ সেগুলো তাদের হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তারও রাজনীতির প্রধান দুটি দিক ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি।

আসিফ নজরুল বলেছেন, গায়েবী মামলার কথা। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, অতীতে গায়েবী মামলার কথা কোনো দিন শোনা যায়নি। তিনি বলেন, এইসব গায়েবী মামলা আদালতে গেলে জামিন মেলে না। তিনি দুই তিনটি উদাহরণ দিয়ে দেখান যে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের অধীনে কয়েকটি মামলা করা হয়েছিল। এর কয়েকটি মামলা আদালত গ্রহণ পর্যন্ত করেনি। তিনি বলেন, মোবাইল ফোন চেক করা কোনো দেশে হয় না। অতীতেও এদেশে হয়নি। যদি বলেন আগে তো মোবাইল ফোন ছিল না, তখন তো মানুষ ছিল। তাদের তো দেহ তল্লাশী করা যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন যে, তিনি সম্প্রতি হজ¦ করেছেন। সেখানে শফিক নামের এক ব্যক্তির সাথে দেখা হয়। জনাব শফিক ৪ বছর পর বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাড়ার পর জানতে পারলেন যে, তার নামে সন্ত্রাস আইনে মামলা হয়েছে। অথচ তিনি এর আদ্যপান্ত কিছুই জানেন না।

এমনি অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। রাত বিরাতে পুলিশ বিভিন্ন মেসে হানা দিচ্ছে। এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। এগুলো এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু দেখার কেউ নেই। বিচার করার কেউ নেই। কর্তৃপক্ষ যা ইচ্ছা তাই করছে। ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। তারা কি দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে? এমনি অসংখ্য প্রশ্ন আসিফ নজরুলের এবং অসংখ্য মানুষের। ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/552686