৩০ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১২:৫৯

মাধ্যমিকে কেন শিক্ষার্থী কমছে

সদ্য মা হয়েছেন আয়েশা ইয়াসমিন। তার দুই ভাই, একজন কাজ করে চাতালে। আর ছোট ভাই পড়ছে কওমি মাদ্রাসায়। করোনার আগে আয়েশা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এরপর আর স্কুল যায়নি সে। এর দুই বছরের মধ্যে বিয়ে হয় আয়েশার। ভাইদের মধ্যে বড় সবুজ অষ্টম শ্রেণির পর আর স্কুলে যায়নি। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ীর প্রত্যন্ত এক গ্রামে বাস তাদের। তাদের বাবা ভাড়ায় অটোরিকশা চালান। করোনায় স্কুল বন্ধের সময় কাজে যোগ দেয় সবুজ।

টানাপড়েনের সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়া ছেড়ে আয়ের পথ বেছে নেয়। আর সব ছোট ভাই ইসমাইল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিকে পড়লেও এখন যায় মাদ্রাসায়। এই পরিবারটির অবস্থায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার পুরো চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে।

সবুজ বলে, আব্বা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। আম্মাও অসুস্থ। এখন আমি স্কুল গেলে না খেয়ে থাকা লাগবে। আয়েশা ও সবুজের শিক্ষক মো. হামিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। লেখাপড়া থেকে আয়ের পথ বেছে নেয়াটাই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। করোনার সময় সকলের আয়ের একটা ভাটা পড়ে। অনেকেই জড়িয়ে গেছে কর্মসংস্থানে। যারা স্কুলছাড়া হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনা এখন অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু দানের পরিমাণটা বেশি। খরচ লাগে না বা খুব কম লাগে এজন্য অনেকেই মাদ্রাসাগুলোতে ভর্তি হচ্ছে।

সরকারি অর্থায়নে হওয়া এক গবেষণায় উঠে এসেছে চার বছরের ব্যবধানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। আবার এই সময়ে কারিগরি, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থী বেড়েছে। গতকাল বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) করা ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩’ এর প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৯২ লাখ ৩ হাজার ৪২৭ জন। ২০২৩ সালে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৮ জন। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশই ছাত্রী। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়াও স্কুল অ্যান্ড কলেজ অর্থাৎ যেখানে উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরেও পড়ানো হয় এসব শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার।

এই চার বছরের দাখিল ও আলিম ধারার মাদ্রাসায় আড়াই লাখের বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী ২৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ছাত্রী প্রায় ৫৪ শতাংশ। ৫৮৮টি সরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। চার বছর আগে যা ছিল ৭ লাখের মতো। কারিগরির শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৯ শতাংশ ছাত্রী। বর্তমানে ১২৩টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করছে ২৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী; যা চার বছর আগে ছিল ২৬ হাজারের বেশি। ব্যানবেইস শিক্ষার্থীদের তথ্য বিশ্লেষণ করলেও কী কারণে ঝরে পড়েছে সেটা তুলে ধরেনি।

ব্যানবেইসের খসড়া প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। মাধ্যমিকে এখন ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ, যা চার বছর আগে ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। মাধ্যমিক পেরোতে পারলে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার হারটি কম থাকে। তবে চার বছরের ব্যবধানে উচ্চ মাধ্যমিকে এই হার বেড়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার এখন ২১ শতাংশের বেশি, যা চার বছর আগে ছিল ১৮ শতাংশের বেশি।

কেন ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা? দিনাজপুর সদরের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন শ্যামল কান্তি সিংহ রায়। গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর শ্যামল বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক। এখন শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে সেইসঙ্গে কাজ কমে আসছে। আবার কৃষিতে টেকনোলজি আসার কারণেও কাজের হারটা কমছে। এই শিক্ষার্থীরা এখন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে অন্য পেশায়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছদ্যবোধ করায় লেখাপড়া থেকে সরে যাচ্ছে এসব শিক্ষার্থী। তাদের কাছে লেখাপড়া করাটা অনিশ্চিত ভবিষ্যত।

তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারগুলোতে মেয়েদের বাড়তি বোঝা হিসেবে ধরা হয়। তাই তারা যত দ্রুত বিয়ে দিতে পারে ততই ভালো হিসেবে ধরে নেয়।

কুড়িগ্রাম জেলায় নাগেশ্বরী উপজেলায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেন আহসান হাবিব। তিনি বলেন, এমন শিক্ষার্থী আছে যাদের পাঁচ টাকার একটা কলম কিনতে অপেক্ষা করতে হয়। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা প্রাথমিকের পরই মানে কর্মক্ষম হবার পরই কাজে যোগ দেয়। কারণ দিনব্যাপী কাজ করলে তার সে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পায়। এই টাকাটা তার পরিবারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষার্থী লেখাপড়া করলে প্রথমত তার পরিবারে কন্ট্রিবিউশন থাকছে না। আবার বাবা-মায়ের ওপর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে। তাকে রীতিমতো যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়। আবার লেখাপড়া করে যে ভালো কিছু করতে পারবে এই আত্মবিশ্বাসটাও পাচ্ছে না। তার থেকে সে নিয়মিত কাজে গেলে একটা আয়ের পথ করে নিতে পারে।

তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু করোনার সময় সব পরিবারেই আয়ে ভাটা পরে। এই সময়টায় তারা কোনো না কোনো পেশায় জড়িয়ে যায়। যার ফলে আয়ের একটা ব্যালেন্স হয় ও পরবর্তীতে আয়ের পথ থেকে স্কুলে পাঠানো কষ্টকর হয়। আর মেয়েদের বাবা-মা যত দ্রুত বিয়ে দিতে পারে তত ভালো। ছেলে পাওয়া ও খরচ কম হবে বলে ধরে নেয়। আধুনিকতার কারণে গ্রামেও এখন মোবাইল সবার হাতে। মেয়ে নিজ পছন্দে বিয়ে করার একটা ভয় থাকে তাদের। এখানে ভয়টা হচ্ছে- মেয়ে ভুল ছেলের পাল্লায় পড়ে পালিয়ে যেতে পারে। আর মেয়ের নামে বদনাম ছড়ালে ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে সমস্যায় পড়বে। এজন্য মেয়ে বড় হবার আগেই বিয়ে দিতে দরিদ্র পরিবারগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর মেয়ের পেছনে খরচ করতেও আগ্রহী ও সক্ষমতা নেই পরিবারগুলোর।

এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, অনেক অভিভাবকের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে কোভিডের কারণে। এজন্য এখন ছেলে-মেয়েদের মাদ্র্রাসায় দিতে আগ্রহী হচ্ছে। কারণ অনেক মাদ্রাসায় খাবার, কাপড় ও বিনামূল্যে দেয়া হয় অনেক সময়। যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তারা চিন্তা করছে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালে ভালো হবে। কিন্তু ইংরেজি মিডিয়ামে কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যানগুলোতে ভালো লেখাপড়া হয় না।

তিনি আরও বলেন, গ্রামে ছেলে শিক্ষার্থী কম হওয়ার কারণ দেখলাম অষ্টম শ্রেণির পাসে বিদেশে যাবার সুযোগ মিলছে। গত প্রায় ১৩ লাখ বিদেশে গিয়েছে। বাবাদের আয়ে সংসার চলছে না। তাকে বাবার আয়ে যোগ করতে হচ্ছে। এসব কারণেই মূলত মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী কমছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, করোনার সময়ে আমরা প্রতিবেদনে চারটি শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে, বাল্যবিবাহ বাড়বে, শিশুশ্রম ও অপুষ্টি বাড়বে। এই চারটি আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো অধিকাংশই লিল্লাহ বোডিং। শিক্ষার্থীরা প্রায় বিনামূল্যে পড়তে পাচ্ছে। যার কারণে অভিভাবকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আর বাবা-মায়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন। যেটা অধিকাংশই ঠিক না। বর্তমানে শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ খুবই কম। যেখানে পারিবারিক বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ অভিভাবকদের বহন করতে হয়। এই কারণেই মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে, সেইসঙ্গে স্কুল-কলেজ থেকে ঝরে পড়ছে।

https://mzamin.com/news.php?news=103840