৩০ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১২:০৩

ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় জাল নোট চক্র

ঈদুল ফিতর সামনে রেখে জমে উঠেছে রাজধানীর মার্কেটগুলো। এরই মধ্যে জাল নোট তৈরি ও সরবরাহ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠছে চক্রের সদস্যরা। চক্রটি ঈদকে সামনে রেখে এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি ও সরবরাহ করতে তোড়জোর শুরু করেছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। তৈরি করা এসব জালনোট ছড়িয়ে দিতে এবং বিক্রির জন্য চক্রের সদস্যরা বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে (যেমন- এ গ্রেড জালনোট, টাকা চাই, জালনোট, জাল টাকা বিক্রি করি, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রির কেন্দ্র, রিয়েল সেলস, টাকা বিজনেস ইত্যাদি) পোস্ট করেন। এরপর জাল টাকা কিনতে আগ্রহীদের সঙ্গে ভুয়া আইডি খুলে ইনবক্সে যোগাযোগ করেন। পরে তারা সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জাল টাকা ডেলিভারির কাজ করেন। এই চক্রের তিন সদস্য ধরা পড়েছে র‌্যাবের গোয়েন্দা জালে। তাদের কাছ থেকে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছে র‌্যাব।

রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনিচক, মৌচাক, গুলিস্তান মার্কেট ছাড়াও বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কসহ বড় বড় শপিং মলে ঈদ কেনাকাটার ভিড়ে প্রতিদিন চক্রগুলো সক্রিয় থাকে জালনোট ছড়িয়ে দিতে। ঈদ বাজারে জাল টাকার নোট চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করছে কারবারিরা। ঈদের কেনাকাটার সময় তাড়াহুড়া ও ভাংতি নোটের প্রয়োজনীয়তার সুযোগ নেয় জাল নোট কারবারি চক্র। তদন্তকারীরা বলছেন, দ্রুত নিখুঁত জাল নোট তৈরি করতে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। তারা এখন পাঁচশ’ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ৫০ টাকার নোটও জাল করছে। জামিনে থাকা আরো কিছু চক্র জাল নোট ছাড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জাল নোট তৈরির চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর তারা জামিন নিয়ে এসে ফের এই ব্যবসায় জড়ায়। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ আইনজীবীও। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে জাল নোট চক্রের সদস্যরা ধরা পরার পর সহজে জামিনে এসে ফের জাল নোট তৈরি করে বাজারজাত করছে। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পার্সেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাল নোট পৌঁছে দিচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

এক লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজার : র‌্যাব বলছে আসন্ন ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল একটি চক্র। তারা পাঁচ লাখ টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সম্প্রতি প্রায় ১৩ লাখ জাল টাকার অর্ডার সরবরাহের সূত্র ধরে এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন-জালনোট তৈরি চক্রটির হোতা মো. আরিফ ব্যাপারী (২০) ও তার অন্যতম প্রধান সহযোগী মো. জাহিদ (২৩) এবং অনিক (১৯)। গত বুধবার রাতে শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার দুর্গম চরমোহনসহ আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এসময় ২০ লাখ টাকার সমপরিমাণ জাল নোট ও জাল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, প্রিন্টারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দন আহমেদ বলেন, নড়িয়ার ঘড়িষাড় ইউনিয়নের বাংলাবাজারে একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করতেন আরিফ। ইউটিউব ভিডিও দেখে এবং নিজের কম্পিউটার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জাল নোট তৈরি শুরু করেন। আর সেই জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে জাহিদ ও অনিককে সহযোগী হিসেবে নেন আরিফ। এরপর তারা মিলে জাল টাকা ছাপানোর কাজ শুরু করেন। তাদের তৈরি করা জাল টাকা বিক্রির পোস্ট দিতেন ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে। এই পোস্ট বুস্টিংয়ের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা সংগ্রহ করতেন।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক জানান, গ্রেফতাররা এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ঈদ উপলক্ষে জাল নোটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি শুরু করেন। লে. কর্নেল আরিফ বলেন, রাজধানীর বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করা বেশিরভাগ লোক শরীয়তপুর জেলার। ফলে আরিফ পরিচিতদের সূত্র ধরে বিভিন্ন সময় রাজধানীর বাংলাবাজারে এসে অবস্থান করে প্রিন্টিং সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। সে ধারণা থেকেই জাল টাকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, যেমন রং, কালি ও কাগজ পুরান ঢাকা থেকে কিনে নেন। এর আগে চক্রটি জাল টাকার একাধিক বড় চালান ডেলিভারি দিয়েছে। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এলাকায় জাল নোট সরবরাহ করতেন বলে স্বীকার করেছেন। গ্রেফতারদের বর্ণনা দিয়ে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, আরিফ এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর পড়ালেখা ছেড়ে তিনি নড়িয়ায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ নেন। দোকানে কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতেন সেই টাকা জমিয়ে জাল নোট ছাপানোর জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। পরবর্তীতে তার নিজ ঘরে কম্পিউটারের দোকানের কাজের আড়ালে জাল নোট ছাপানো শুরু করেন। তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে ছিলেন জাহিদ এবং অনিক। জালনোট বিক্রি করে যে টাকা পেতেন তার অর্ধেক আরিফ নেন এবং বাকি অর্ধেক জাহিদ ও অনিক ভাগ করে নেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন।
‘ভিডিও চিত্র’ দেখানোর নির্দেশনা : ঈদ সামনে রেখে জাল টাকার বিস্তার প্রতিরোধে রোজার মাসে সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিন জনসমাগম হয়, এমন উন্মুক্ত স্থানে ‘ভিডিও চিত্র’ প্রদর্শনে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাটবাজার, শপিং মল, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন বা রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টা ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে প্রতিদিনি এই ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করবে। আর অন্যান্য ব্যাংকগুলো রাজধানীরকে কোন স্থানে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করবে তার তালিকা করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জাল নোটের বিস্তার রোধ করতে এমন নির্দেশনার কারণ ব্যাখ্যায় সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ‘বিভিন্ন উৎসবের প্রাক্কালে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রেক্ষিতে আসন্ন পবিত্র রমযান মাস উপলক্ষে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা প্রতিরোধকল্পে পদক্ষেপ গ্রহণে আপনাদেরকে পরামর্শ প্রদান করা হলো।’ বিভাগীয় শহর ও বগুড়া জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ জনসমাগমস্থলে ভিডিওচিত্র দেখানোর নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, উন্মুক্ত স্থানের পাশাপাশি সব ব্যাংকের শাখায়ও তা প্রদর্শন করতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/552651