২৪ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৩:৫৪

বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এসব হচ্ছে?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। একের পর এক ঘটনা ঘটছে। নানা ইস্যুতে চলছে আন্দোলন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনায় ধিক্কার কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তার শেষ কর্মদিবসে ৩২ জনকে নিয়োগ দিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রমজানকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান ঘিরে চলছে বিতর্ক। দেশের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন এসব ঘটনা ঘটছে এমন প্রশ্নে শিক্ষাবিদরা বলছেন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা কমে যাওয়া, শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হওয়া এবং ক্ষমতার বলয়ে থাকার প্রবণতা এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে। এ ছাড়া জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাও স্বেচ্ছাচারমূলক কর্মকা- চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, নানা কারণেই এগুলো হচ্ছে। যৌন হয়রানি, নিয়োগ বাণিজ্য বাড়ছে; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা গণতন্ত্রমনস্ক না।

অস্থিরতা চলার আরেকটা কারণ হচ্ছে বর্তমানে সারা দেশে ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এখন ৫৬ জন করে যোগ্য ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার, প্রক্টর নেই। তাদের কোনো বায়োডাটা নেই। যে যখন যেখান থেকে তদবির করতে পারছে সেখান থেকেই নিয়োগ নিয়ে নিচ্ছে। অনেক ভাইস চ্যান্সেলর অযোগ্য হয়েও নিয়োগ পাচ্ছেন। আবার অনেকে যোগ্য হয়েও ওই জায়গায় যেতে পারছেন না।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। তারা দায়িত্ব থেকে অনেক সরে এসেছেন। যখন শিক্ষকরা দায়িত্ব থেকে সরে আসছে তখন ভাইস চ্যান্সেলরদেরও করার কিছু থাকছে না। ছাত্রদের মাঝে ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসটা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খারাপ সময় যাচ্ছে। তবে প্রোপার কেয়ার নিলে, সরকার সুনজর দিলে এগুলো কেটে যাবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য এক হয়ে গেছে। এমন শিক্ষায় সমাজের নৈতিক অর্জন কমতে থাকে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। মূলত, শিক্ষকরা নৈতিক অবস্থানে থেকে আর শিক্ষা দিচ্ছেন না।

ঢাবিতে ধর্মীয় ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ বাড়ছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকে নানা ইস্যুতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রমজান শীর্ষক শিক্ষার্থীদের আলোচনায় হামলা, ধর্মীয় ইস্যুতে প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। ঢাবি ক্যাম্পাসে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ‘একচেটিয়া আধিপত্য’ কায়েম করেছে বলে অভিযোগ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের। গত দুই বছরে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপরে ২০ বারের বেশি হামলা হয়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগেই ছাত্রলীগের নাম এলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ঘটনা: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়টি। অবন্তিকা মৃত্যুর আগে ফেসবুক স্ট্যাটাসে মৃত্যুর জন্য দায়ী করা সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ। তার মৃত্যুর পর আন্দোলনে সোচ্চার হন শিক্ষার্থীরা। দাবি জানান সুষ্ঠু বিচারের। আবার অবন্তিকার মৃত্যুর পর সামনে আসে পূর্বের ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে শিক্ষার্থী কাজী ফারজান মিমের বিষয়টিও সামনে আসে। তিনি শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি। এই শিক্ষার্থীর দাবি, বিচার তো মেলেইনি উল্টো নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। শিক্ষকরা তাকে পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃত ফেল করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে অসহযোগিতা করায় বিভাগের প্রধান জুনায়েদ আহমদ হালিমকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চালায় কারা?: দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পান ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও ইউজিসি সদস্য মো. আবু তাহের।
এর আগে নিয়োগ নিয়ে গত বছরের ১৭ই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও আইন বিভাগে বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে চবি শিক্ষক সমিতি। পরে এ আন্দোলন রূপ নেয় ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগের একদফা দাবিতে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনসহ প্রায় দুই মাস নানা কর্মসূচি পালন করেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ব্যাহত করে। ভিসি অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার নিয়োগের শেষ দিনে ৩৭ জনকে নিয়োগ দেন। এর আগেও ২০১৯ সালে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ১৭২ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার মূলে ছাত্ররাজনীতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগের ৯টি উপগ্রুপ সক্রিয়। তুচ্ছ ঘটনা, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়ায় উপগ্রুপগুলো। সংঘর্ষের সময় দেশীয় অস্ত্র হাতে দেখা যায় নেতাকর্মীদের। এসময় প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পয়েন্ট আটকে রাখে। এতে আতঙ্কে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকতে হলে হলভিত্তিক উপগ্রুপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুক্ত হতে হয় শিক্ষার্থীদের।
গত চার বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলো অন্তত দেড়শ’ বারেরও বেশি সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=103013