২৪ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৩:৩৬

বিচারক বলেছেন দেশকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলা হয়েছে : গত আড়াই মাসে এসব কী ঘটছে?

-আসিফ আরসালান

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের শুরু হয়েছে নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ওপর কটাক্ষ করা বা ক্ষেত্রবিশেষে আঘাত করা। ৭ জানুয়ারির পর মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত আওয়ামী সরকার সকলের বিস্ময় উৎপাদন করে ধর্মবিশ^াসকে খাটো করার প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হয়। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা এমন সব কাজ করে যেগুলোকে এবি পার্টিসহ একাধিক পার্টি ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার বাস্তবায়ন বলে মনে করছে। আরো অবাক ব্যাপার হলো এই যে, আওয়ামী সরকারের এসব অপকীর্তির খবর মেইনস্ট্রিম পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মোটেই প্রকাশ করছে না এবং সম্প্রচার করছে না। কিন্তু আওয়ামী সরকারের এসব অপকীর্তিতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ভয়ানক রুষ্ট। তারা যে কতদূর রুষ্ট সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গেলেই টের পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের ঐসব অপকীর্তির প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে। নমুনা হিসেবে নীচে একজনের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হুবহু তুলে ধরছি।

“ঐ দল (আওয়ামী লীগ) আর ইসলাম একসাথে যায় না! সমস্যা কোথায় ওদের? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলে তারাবির নামায পড়ার জন্য পিটায়! ক্যাম্পাসে ইফতার মাহফিল করার জন্য পিটায়! কুরআন তেলাওয়াত করলে পিটায়! ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইফতারের বিরোধিতা করে। আলেম ওলামাদের বছরের পর বছর জেলে রাখে! পছন্দ না হলে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়! সেরা বক্তাদের ওয়াজ মাহফিলে বাধা দেয়!” এরপর আর বলার কিছু থাকে না। কেউ যদি মনে করেন যে, এগুলো আমরা অর্থাৎ দৈনিক সংগ্রাম বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি তাহলে তাদের উদ্দেশে বলতে চাই যে, অকাট্য প্রমাণ হাতে রেখেই আমরা এসব উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এই উদ্ধৃতির স্ক্রিন শট আমরা সংরক্ষণ করেছি।

এই ধরনের ভয়াবহ ঘটনা যে ভবিষ্যতে ঘটবে সেটি আকলমান্দ ব্যক্তিরা পূর্বাহ্নেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমরা তো অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। উচ্চ আদালতের একটি অঙ্গ হলো হাইকোর্ট। সেই হাইকোর্টের একজন বিচারপতি একটি মামলা শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের উকিলকে বলেছিলেন, “দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন”। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিনের করা আপিলের গ্রহণযোগ্যতা-বিষয়ক শুনানিতে ১০ অক্টোবর ২০২৩ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।

এক দশক আগের ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারার মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর আদিলুর ও নাসিরকে দুই বছর করে কারাদ- দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ মাস করে কারাদ- দেয়া হয়। এই জেল-জরিমানার রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান আদিলুর ও নাসির। গত বছরের ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার বিষয়টি শুনানির জন্য হাইকোর্টের উল্লিখিত বেঞ্চে ওঠে। তখন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক উপরোক্ত মন্তব্য করেন।

॥ দুই ॥
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ ভবনের মসজিদে পবিত্র কোরআনের আলোকে রমযান নিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের পূর্ব নির্ধারিত আলোচনা সভায় হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত পাঁচ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের চালানো এ হামলায় ক্যাম্পাসে সমালোচনার ঝড় ওঠে, প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। এক সপ্তাহ পার হতে চললেও এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রশাসন আশ্বাস দিলেও ভুক্তভোগীসহ অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী এই হামলার ঘটনায় আদৌ সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কোনো কোনো পত্রিকা লিখছে যে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা হিন্দুদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আলোচনা সভায় আজ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র গোলযোগ সৃষ্টি করেনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে ছাত্রলীগের যত আক্রোশ সব ইসলামী ও মুসলমানদের অনুষ্ঠানে।

আজ বাংলাদেশে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর কোনো পাঠ্যক্রম নেই। বরং পাশের দেশ ভারত থেকে নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করার ছায়াছবি ও অন্যান্য টেলিভিশন ফুটেজ দেদারসে এদেশে দেখানো হচ্ছে। এগুলো দেখে দেখে এখানকার যুবক শুধু নয়, শিক্ষকরা পর্যন্ত ক্রিমিনাল হিসেবে গড়ে উঠছে। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে এখানে দুটি উদাহরণ দেবো। একটি হলো জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রী অবন্তিকার আত্মহত্যা। আরেকটি হলো, প্রকাশ্য ক্লাসে শিক্ষক কর্তৃক পকেট থেকে পিস্তল বের করে ছাত্রকে গুলী করা।

ফাইরুজ সাদাব অবন্তিকা আত্মহত্যার আগে একটি চিরকুট লিখে গেছে। অবন্তিকা গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করে। ফেসবুকে পোস্ট করা সুইসাইড নোটে সে লিখেছে- “আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম! আর পোস্টমর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।”

অবন্তিকা তার পোস্টে আরও লিখেছে- “আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন-অনলাইনে থ্রেটের ওপর রাখত, সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার।” অবন্তিকার এই করুণ আর্তনাদে পাষাণ হৃদয়ও গলে যায়। কিন্তু এখনকার মুখচেনা পান্ডা এবং তাদের গডফাদারদের হৃদয় গলে না।

দ্বিতীয় ক্রাইমের ভিলেন হলো সিরাজগঞ্জের শহীদ মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ। তিনি ছাত্র আরাফাত আমিন তমালকে ক্লাসের মধ্যে পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলী করেন। সিডিউল বহির্ভূত বিষয়ে পাঠদানের বিরুদ্ধে ছাত্র তমাল শিক্ষক রায়হান শরীফের কাছে প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদে ক্রুদ্ধ হয়ে রায়হান তাকে গুলী করে। পুলিশী জেরার মুখে ঐ শিক্ষক রায়হান শরীফ স্বীকার করে যে, ভারতীয় সুপারহিট হিন্দি ছবি ‘অব-তক ছপ্পান’ এর অভিনেতা নানা পাটেকরের মারদাঙ্গা চরিত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে গুলী করার মতো রোমহর্ষক কা- ঘটিয়েছে।

॥ তিন ॥
দেশ কোথায় যাচ্ছে? এটি অত্যন্ত পুরাতন প্রশ্ন। কিন্তু সাধারণভাবে বিগত ১৫ বছরের এবং বিশেষভাবে ৭ জানুয়ারির পর যা ঘটছে সেটি কোনো স্বাধীন সার্বভৌম আইনের শাসন সম্পন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঘটতে পারে না। মেজর হাফিজ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বন্দুক হাতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সেই মেজর হাফিজ আজ বলেন, ‘আজ আমরা অনেকটাই পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি। বাংলাদেশে কী রাজনীতি চলছে, কারা আমাদের এই স্বকীয় স্বাধীনতা হরণ করছে, কারা ব্যাংক লুট করছে, কারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করছে, এটা সবাই জানে।’ গত ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির গঠিত ‘স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন কমিটি’র বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কমিটির আহ্বায়ক হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
আরেকটি ভয়াবহ ও বীভৎস ঘটনা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি হলো ধর্ষণ ও গণধর্ষণ। ২০১৯ সালের শুরুতে ৬ সন্তানের মাতাকে গণধর্ষণের ঘটনা আমরা জানি। যারা ঘটিয়েছিল তারা সব শাসকদলের লোক। ঘটনাটি ঘটেছিল সুবর্ণচরে।

ধর্ষণ এবং নরহত্যা এখন যেন একে অপরের সহচর হয়ে গেছে। ধর্ষণ এবং নারী হত্যা যেন পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো এই যে এখন সমাজ বিরোধীরা চার পাঁচ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান এবং ইবনে সিনার নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়ার হত্যাকান্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব খবর পড়ার পর আমরা ভাবছি, দেশটি কোথায় যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে বিএনপি জামায়াতকে দমন করার জন্য সরকার যে এনার্জি খরচ করছে তার এক ভগ্নাংশও যদি দেশের ক্রাইম অর্থাৎ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড প্রতিরোধে ব্যয় করা হতো তাহলে এই ধরনের ভয়াবহ অপরাধ সম্পূর্ণ দূরীভূত না হলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসতো।

এসম্পর্কে তথাকথিত মূলধারার পত্র পত্রিকাসমূহ অর্থপূর্ণ নীরবতা বজায় রাখলেও সমাজের বিবেকবান মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাদের মতে আজ বাংলাদেশে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দমন পীড়নই চলছে না, সারা দেশের সমাজ নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাসে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বিবর্জিত শিক্ষাক্রম এবং প্রগতিশীলতার নামে উলঙ্গ বেলেল্লাপনা এই মহা সর্বনাশের মূল কারণ। এসম্পর্কে সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো। প্রফেসর ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেছেন, ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত শিক্ষাক্রম এবং প্রগতিশীলতার নামে উলঙ্গ-বেলেল্লাপনা অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের ঘৃণ্য অপরাধে শিক্ষক সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছে। প্রফেসর ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে অধঃপতন। ডা. ফওজিয়া মুসলিম বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বারবার এমন ঘটনা ঘটতো না। প্রফেসর ড. আব্দুল আলীম বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক। প্রফেসর ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে শিক্ষকদের নৈতিকতা না থাকলে কী শিক্ষা দেবে?
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/552104