২২ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৪:৩৫

সর্বনাশ জেনেও ভূগর্ভের পানিই ভরসা ওয়াসার

তিলোত্তমা নগরী ঢাকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে প্রতিদিনই বাড়ছে পানির চাহিদা। দূষণের কারণে ঢাকার চারপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি ব্যবহারের উপযোগিতা না থাকায় চাহিদার জোগান দিতে ভূগর্ভস্থ পানিই যেন হয়ে উঠেছে ‘অন্ধের নড়ি’। তথ্য বলছে, প্রায় ৭০ শতাংশ পানি তুলতে হচ্ছে মাটির গভীর থেকে। তবে যে হারে পানি খরচা হয়ে যাচ্ছে তাতে দ্রুত নামছে পানির স্তর। নিয়ম না থাকলেও সিটি করপোরেশন এলাকায় তুমুল উৎসাহে বসছে গভীর নলকূপ। এতে চাপ পড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, নষ্ট হচ্ছে সুপেয় পানির উৎস।

‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির আওতায় নেওয়া উদ্যোগে বলা হয়েছিল– ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভূউপরিস্থ পানির (সারফেস ওয়াটার) উৎপাদন বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ করা হবে। আর ভূগর্ভস্থ পানির উৎপাদন ৩০ শতাংশে নামানো হবে। এ জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিলেও ফল হয়েছে উল্টো। এখন প্রতিদিন ঢাকা ওয়াসা যে ২৯০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে এর ৭০ শতাংশই আসছে গভীর নলকূপ থেকে। ৩০ শতাংশ পানি মিলছে ভূউপরিস্থ উৎস থেকে।

এমন পটভূমিতে নানা আয়োজনে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। প্রতি বছরের ২২ মার্চ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়।

অনিয়ন্ত্রিত গভীর নলকূপ
২০১০-১১ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার প্রতিদিন পানি উৎপাদনের গড় সক্ষমতা ছিল প্রায় ২০০ কোটি লিটার। এর মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি লিটার (৫০ শতাংশ) পানি আসত গভীর নলকূপ থেকে। বাকি ৫০ শতাংশ পানি মিলত ভূউপরিস্থ নদীর পানি শোধন করে। তবে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়, ভূমিধস ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ার শঙ্কায় ঢাকা ওয়াসা পর্যায়ক্রমে গভীর নলকূপের সংখ্যা কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর বার্তা দিয়েছিল। তবে ঢাকা ওয়াসার সেই আশা গুড়েবালি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উৎস প্রায় শেষের পথে। প্রতিবছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার নেমে যাচ্ছে। যে কারণে অনেক গভীর নলকূপে পানি আসছে না। অনেক নলকূপের কমছে উৎপাদন ক্ষমতা। এতে করে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে ঢাকা মহানগরী।

জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ ছিল ৫৮৬টি। বছর বছর বেড়ে এখন তা হয়েছে ১ হাজার ৮১টি। এর মধ্যে ৯৫৬টি নলকূপ দিয়ে নিয়মিত ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তোলা হচ্ছে। ২০টি নলকূপ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত বুধবারের হিসাবে দেখা গেছে, ওই দিন ঢাকা ওয়াসা ২৮৯ কোটি ৮৫ লাখ লিটার পানি উৎপাদন করে। এর মধ্যে ২০৫ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায় গভীর নলকূপ থেকে। এ ছাড়া চারটি পানি শোধনাগার থেকে এসেছে ৮৪ কোটি ৭৬ লাখ লিটার। ফলে উৎপাদিত পানির প্রায় ৭০ শতাংশই আসছে ভূগর্ভস্থ থেকে।

এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপন করা অন্তত আরও ২ হাজার গভীর নলকূপ রয়েছে রাজধানীতে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলা এ নলকূপগুলোর মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ পানি প্রতিদিন তোলা হচ্ছে। এর বাইরে আরও হাজার খানেক অননুমোদিত গভীর নলকূপ রয়েছে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায়।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমার গতি অস্বাভাবিক
কয়েক দশক আগেই ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও গবেষকরা। পাউবোর গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে। অর্থাৎ ২৫ মিটার গভীরে গেলেই পানির স্তর পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে তা দাঁড়ায় ৪৫ মিটার। ২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৩ সালে তা ৭৫ মিটারে নেমেছে। এভাবে কমতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ১২০ মিটারে নেমে যেতে পারে। কারণ ওয়াসার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ঢাকায় ২০২৫ সালে প্রতিদিন ৩৫ লাখ ঘনমিটার, ২০৩০ সালে প্রতিদিন ৪৩ লাখ ঘনমিটার এবং ২০৩৫ সালে প্রতিদিন ৫২ লাখ ঘনমিটার পানির চাহিদা থাকবে। ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি গভীর নলকূপ দিয়ে তুলছে, তা ৩৩ লাখ ঘনমিটার; যা মিরপুরের শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন ও অনুমোদনহীন নলকূপের মাধ্যমে কী পরিমাণ পানি প্রতিদিন তোলা হচ্ছে সেই হিসাব বাইরে থেকে যাচ্ছে।

ব্যর্থ ভূউপরিস্থ পানি উৎপাদন প্রকল্প
ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ঢাকা ওয়াসা তিনটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে নেওয়া সায়েদাবাদ ফেস-৩ প্রকল্পটি ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এটা পাওয়া গেলে প্রতিদিন ২৩ কোটি লিটার পানি পাওয়া যেত। সে প্রকল্পটির ব্যয় শুরুতে ছিল ৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। এখন বেড়ে ৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬ শতাংশ। ২০১৪ সালে পদ্মা থেকে পানি আনার জন্য নেওয়া হয় পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্প। ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্প ১৯ সালের ১ জুলাই থেকে উৎপাদনে আসে। প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৬ কোটি লিটার। ২০১৫ সালে নেওয়া হয় সাভারের ভাকুর্তায় তেঁতুলঝোড়া ওয়েলফিল্ড প্রকল্প। ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ৫ কোটি লিটার। আর ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া মেঘনা নদীর পানি শোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করার প্রকল্পও কবে উৎপাদনে যাবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা পানির উৎসের টেকসই সমাধান করতে পারেনি। প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। নলকূপনির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিভাগের পানির উৎপাদন বাড়ানোয় জোর না দিলে সংকট কাটবে না। কারণ প্রতিদিন যে পানি উত্তোলন হচ্ছে, সেই শূন্যতা ভূগর্ভে তৈরি হচ্ছে। কারণ ইট-কংক্রিটের জঞ্জাল বানানোর কারণে পানি শোষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে রাজধানী। ভূগর্ভের শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছে না।

ভূগর্ভস্থ পানির উৎস কমছে, সামনে বড় বিপদ
ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাটির নিচে পানি যেতে ঢাকা শহরে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাধার থাকা দরকার। তবে বাস্তবে আছে ৪-৫ শতাংশেরও কম। বৃষ্টির পানি মাটির নিচে ঢোকার মতো জলাধার নেই। কংক্রিট ভেদ করে পানি নিচে যেতে পারে না।

ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় খালের সংখ্যা ৪৭। তবে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও এর সবই মৃতপ্রায়।

ঢাকা শহরে পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। তবে ঢাকায় এখন পুকুরের সংখ্যা একশর কম। জানা গেছে, যে ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়ে গেছে, তাতে জমির পরিমাণ ৭০ হাজার হেক্টর।

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল হারিয়ে গেছে। এটা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনে সুপেয় পানির সংকট এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ততা দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু জায়গায় দেবে যেতে পারে মাটি। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে পানির উৎসগুলো সংরক্ষণে নজরদারি বাড়াতে হবে।

ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, কমবেশি সবাই ব্যাংকে টাকা রাখেন, যেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত হয়। তবে পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার কথা মাথায় রাখছি না। আমাদের মাটির নিচের পানির মান ও পরিমাণ জানতে হবে। জানতে হবে এটার বিপর্যয় কখন হতে পারে। আরেকটি হচ্ছে, ভূউপরিস্থ পানি তদারক করা। পানির অবস্থা বুঝে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ সতর্ক করে বলেন, কাদামাটির স্তর বালুর স্তরের ঠিক বিপরীত আচরণ করে। কাদার স্তরে (যার পুরুত্ব ৬০ ফুট পর্যন্ত) ডিপ্রেশন তৈরি হলে ভূমিধস হতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, মানুষ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে যে পানি তুলে ফেলতে পারে, তা প্রাকৃতিকভাবে পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। রাজধানীতে ভবন বেড়ে যাওয়া ও কংক্রিটের অবকাঠামো বাড়তে থাকা এবং ক্রমেই জলাশয় বিলুপ্ত হতে থাকায় ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিকভাবে ফের ভরার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। পলির ধরনের ওপর নির্ভর করে বৃষ্টি বা বন্যার পানি ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট গভীরে যেতে অন্তত ১০০ বছর এবং ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট গভীরে যেতে প্রায় ১ হাজার বছর সময় লাগে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থের পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

ওয়াসা যা বলছে
ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সারফেস ওয়াটার থেকে ৭০ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্য ছিল। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা এখনও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। এটি বাস্তবায়নে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করতে হচ্ছে, তবে ঋণের টাকা সংগ্রহে তা বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। গন্ধবপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ২০২৩ সালের মধ্যে চালুর কথা থাকলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। এই প্লান্টের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিষনন্দী এলাকা থেকে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করার কথা ছিল। রাস্তা কাটা, রাস্তা খনন– এসব বড় সমস্যা। আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে দ্রুত ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো চালু করব। আগামী বছর গন্ধবপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট চালু করার চেষ্টা করছি। তাহলে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অনেকটা চাপ কমবে। কারণ গভীর নলকূপ টেকসই নয়।

https://samakal.com/bangladesh/article/228945