২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:২৪

পরিবেশ দূষণে ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

কমছে আয়ু, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি, নষ্ট কর্মঘণ্টা

বায়ুদূষণের ভয়াবহতা থামছে না। দিন দিন বাড়ছে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ ঢাকার বায়ুদূষণ। সে সাথে গত তিন বছরে ঢাকা দূষণে ৭ ধাপ এগিয়েছে। সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর। আর ঢাকা নগরীতে আয়ু কমেছে প্রায় আট বছর। সে সাথে বেড়েছে মৃত্যুসহ ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। কমেছে কর্মঘণ্টা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী হলো ইটভাটা, অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, যানবাহনের ধোঁয়া। এতে করে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক আকারে বাড়ছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, অটিজম, স্নায়ুজনিত সমস্যাসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, চলমান পরিস্থিতি সামাল না দিলে তা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে।

এর আগে পরিবেশ অধিদফতর একটি প্রতিবেদনে জানায় ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজের অনিয়ন্ত্রিত ধুলা। এর পরও তা নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে গতকাল পরিবেশ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, 'এমন পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। তাই আমরাও এ বিষয়ে কাজ করছি। আশা করি এক সময় দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা মতে, ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত কারণে ঢাকায় ২২ হাজারের বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। যার হার এখন বাড়ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ অকালে মারা যায়। আর বাংলাদেশের বায়ুদূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্নতায় ভুগছেন। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দু'টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।

অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা পিওর আর্থ বলছে, বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের প্রধান কারণ দূষণ। অসংক্রামক রোগের মৃত্যুর ৭২ ভাগ এর জন্য দায়ী, যার ১৬ ভাগ দূষণের কারণে ঘটে। এছাড়া, কার্ডিওভাসকুলার রোগের ২২ ভাগ, স্ট্রোক
২৫ ভাগ, ফুসফুসের ক্যান্সারে ৪০ ভাগ ও ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পুলমানারি ডিজিজ, ৫৩ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী বিষাক্ত দূষণ। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন পরিবেশবিজ্ঞানী ড. কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, গত প্রায় আট বছর ধরে কমবেশি বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে বায়ুদূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। এ ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে বিধি না মানা। ইটভাটা, পুরনো যানবাহনের ধোঁয়া মূলত দায়ী। নানাভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে ধাপে ধাপে এখন বাংলাদেশ দূষণের শীর্ষে পৌঁছে গেছে।

তিনি জানান, ২১ সালে দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশ ছিল সপ্তম। ২২ সালে একধাপ বেড়ে হয় পঞ্চম এবং ২৩ সালে চার ধাপ এগিয়ে প্রথম স্থানে উঠে আসে। এই পর্যায়ক্রমে বায়ুমানের যে অবনতি হচ্ছে এর অন্যতম কারণ হলো দূষণ নিয়ন্ত্রণে টেকসই পদক্ষেপ না নেয়া। এর ফলে মানুষের শারীরিক অর্থনৈতিক ক্ষতির সাথে আয়ু কমছে।

দূষণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই গড় আয় কমেছে আট বছর। কর্মক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। প্রাণী উদ্ভিদও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: আয়েশা আক্তার শিল্পী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বায়ুদূষণে বাতাসের বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে যাচ্ছে। এতে মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। ক্যান্সার, ফুসফুসের প্রদাহ, বিকলাঙ্গ, হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, কিডনি, লিভার সমস্যাসহ মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে। এর সমাধান না হলে তা দিন দিন মানুষকে মৃত্যুপথে ঠেলে দেবে।

দিন দিন হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে এ সংক্রান্ত রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ শরীরের বিভিন্ন কোষ নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে দূষণে শিশুরাও তাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মস্তিষ্কের গঠনে জটিলতার সাথে মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। বিশিষ্ট নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব নয়া দিগন্তকে বলেন, নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি বেসরকারি সব ধরনের নির্মাণকাজ প্রতিবেশবান্ধব করা বাধ্য করতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রথমেই ঢাকার চারি দিকে মালার মতো বিস্তৃত ইটের সব ভাটা বন্ধের পাশাপাশি প্রতিটি নির্মাণস্থল ঢেকে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। শিল্প কারখানায় টায়ার প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ এবং নগরীজুড়ে বনায়ন বাড়ানো গেলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/822959