২০ মার্চ ২০২৪, বুধবার, ১০:২৩

সর্বজনীন পেনশন ঘোষণার প্রজ্ঞাপনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অসন্তোষ

বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন

সর্বজনীন পেনশন ঘোষণায় খুশি হতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা অবিলম্বে এই পেনশন ঘোষণা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে এই পেনশন প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে বিবৃতিও দিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জানিয়েছেন তিনি এই প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করে কথা বলবেন।

উল্লেখ্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছেন রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বায়ত্তশাসিত ও সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগামী ১ জুলাই বা তার পরে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সুবিধার আওতায় আসবেন। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সূত্রমতে, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’-এর বিধান মতে জারি করা সরকারের এ প্রজ্ঞাপন গত ১৩ মার্চ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

এ দিকে হঠাৎ এমন প্রজ্ঞাপন জারির ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে চরম হতাশা ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে । বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন মনে করে, এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। তাই অনতিবিলম্বে এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা ও অসন্তুষ্টি লাঘব করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবিও জানিয়েছে ফেডারেশন।

ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সাথেও সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে শিক্ষা ও গবেষণাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন এবং শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় আরো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনের এই প্রজ্ঞাপন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাদর্শনের প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শনের শামিল বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন মনে করে।

অপর দিকে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো: আখতারুল ইসলাম জানান, এই প্রজ্ঞাপন শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে। কেননা, এর ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হবেন না। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দুরভিসন্ধি রয়েছে কি না সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

উল্লেখ্য, গত বুধবার প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৪-এর উপ-ধারা (২)-এর শতাংশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এর অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী, তারা যে নামেই অভিহিত হোন না কেন, আগামী ১ জুলাই ও তার পরে নতুন যোগদান করবেন, তাদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করা হলো। এ দিকে বিদ্যমান সরকারি পেনশন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশনের আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। প্রজ্ঞাপন প্রসঙ্গে ভিসি মাকসুদ কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, এই প্রজ্ঞাপনের ফলে ভালো কিছু হবে না। আমি বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলব।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষকদের অনেকেই জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে। যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। আর স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যারা কোনো আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, কমিশন, সংস্থা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে। এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ইত্যাদি রয়েছে এ তালিকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ১৪ লাখের বেশি।

এ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে গত আগস্টে চালু হয় সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। তখন চার শ্রেণীর মানুষের জন্য চারটি স্কিম চালু হয়। সে সময় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়- সুবিধামতো সময়ে সরকার আরো দু’টি স্কিম চালু করে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কর্মসূচির আওতায় আনবে। সে ধারাবাহিকতায় এ সিদ্ধান্ত এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো বলছে, নতুন সিদ্ধান্তে আসার আগে এ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান পেনশন সুবিধা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কমিশন ও করপোরেশনে সরকারি কর্মচারীদের আদলেই পেনশন দেয়া হয়, যা এ ধরনের মোট প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এর বাইরে প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলের (সিপিএফ) মাধ্যমে অবসর সুবিধা দেয়া হয়। এ তহবিলে চাকরিজীবীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেন, আর সংস্থা দেয় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অবসরের পর এ টাকা এবং এর বাইরে প্রতি বছর দুই মাসের মূল বেতনের সমান আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) পান তারা। আবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্যৎ তহবিলও নেই। এ ক্ষেত্রে অবসরের পর চাকরিজীবীরা শুধু গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকে। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/822700