১৯ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:২০

পদ্মার নাব্যতা রক্ষার চেষ্টা ব্যর্থ অবশেষে এক্সিমে বিলীন

বিশেষ ছাড় দেয়া হয় সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে

ব্যাপক দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতির ফলে দেউলিয়াত্বের ভাগ্য বরণ করতে যাওয়া সাবেক ফার্মার্স এবং পরে নামকরণ হওয়া পদ্মা ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা চেষ্টা করেছিল। বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার সিআরআর ও তরল সম্পদ এসএলআর সংরক্ষণে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছিল। দণ্ড সুদ পরিশোধেও বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়াও হয়েছিল। সর্বশেষ বিদেশী বিনিয়োগ আনার শর্তে ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী থেকে ৯০০ কোটি টাকার লোকসানের তথ্য গোপন করারও সম্মতি দেয়া হয়। কিন্তু কোনো চেষ্টাই পদ্মার নাব্যতা রক্ষা করতে পারেনি। অবশেষে নিজেকে বিলুপ্ত করে এক্সিম ব্যাংকের মাঝে বিলীন করে দিলো রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক। গতকাল এক্সিম ব্যাংকের সাথে এই ব্যাংকটির একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে পদ্মা ব্যাংকের নাম দেশের ব্যাংকিং খাতে আর থাকবে না। ব্যাংকটির সব কার্যক্রম হবে এক্সিমের নামে।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে একীভূতকরণ নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, তিন ডেপুটি গভর্নরসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানরাও ছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, দেশের উন্নয়নে এটি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, এক্সিম ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ থাকবে এবং একীভূত হওয়ার পর পদ্মা ব্যাংকের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের দুর্বল ব্যাংক নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সে কারণেই এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে।’

জানা গেছে, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ফার্মার্স ব্যাংক ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তার সময়েই ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না ব্যাংকটি। একদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়ায় বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হয়ে যায়। অপর দিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকটির আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এ সময় নতুন করে কেউ আর আমানত রাখছিলেন না। ব্যাপক এক অরাজকতার মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফার্মার্স ব্যাংকের এমডিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ভেঙে দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদকে। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করা মহিউদ্দীন খান আলমগীরের পর ২০১৭ সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগের আরেক ঘনিষ্ঠজন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

এরপর পদ্মা ব্যাংককে টেনে তুলতে পদ্মা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নানা সুবিধা ও ছাড় দিতে থাকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ফার্মার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে।

সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দেয়। ফলে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশই চলে যায় সরকারি ব্যাংকের হাতে।

নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের বিপরীতে এসএলআর হিসেবে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সরকারের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১২১ ধারায় ক্ষমতাবলে পদ্মা ব্যাংককে এক গেজেটের ভিত্তিতে ২০২০ সালে এসএলআর সংরক্ষণে ছাড় দেয়া হয়। এসএলআর সংরক্ষণের হার মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের বিপরীতে ২০২০ সালের জন্য অন্যূন ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২০২১-এর জন্য ৬ দশমিক ৫০, ২০২২-এর জন্য ৯ দশমিক ৭৫ এবং ২০২৩ সালের জন্য অন্যূন ১৩ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
এ দিকে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিআরআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ায় ৫৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ জরিমানা পরিশোধেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদি সময় দেয়া হয়। প্রথমে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল। পরে তা আরো দুই বছরের বেশি সময় বাড়িয়ে ২০২৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।

এরপর গত বছরের আগস্টে বিদেশী বিনিয়োগ আনার শর্তে ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী থেকে ৯০০ কোটি টাকার লোকসানের তথ্য গোপন করারও সম্মতি দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ওই সময় টিআইবিসহ নানা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ওই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সমলোচনা করেছিল। মূলধন সঙ্কটে থাকা ব্যাংকটিকে দেয়া এই সুবিধাকে ‘অনৈতিক ও প্রতারণামূলক’ বলেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পরে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়।

এভাবে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে দেউলিয়াত্বের ভাগ্য বরণ করতে যাওয়া পদ্মা ব্যাংককে বাঁচাতে নানা চেষ্টা করা হয় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কিন্তু পদ্মার নাব্যতা আর রক্ষা করা যায়নি। বরং দিন দিন পদ্মা নাব্যতা হারিয়ে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরই এক পর্যায়ে গত জানুয়ারিতে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। এরপর চেয়াম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন পদাধিকার বলে সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম। সর্বশেষ গতকাল এক সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে নাব্যতা হারানো পদ্মা নিজেকে বিলীন করে দিয়ে এক্সিম ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে।
গতকাল এমওইউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন, আগামীকাল (অর্থাৎ আজ) থেকে আর পদ্মা ব্যাংক থাকছে না। ব্যাংকটিকে একীভূত করার কারণে নতুন কার্যক্রম চলবে এক্সিম ব্যাংকের নামে। একীভূত করা হলেও কোনো এমপ্লয়ি চাকরি হারাবেন না। তবে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকরা এক্সিম ব্যাংকের পরিচলানা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত হয়নি দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়েও। নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পদ্মা ব্যাংকে একীভূত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো চাপ ছিল না, তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল। আমরা এটা করেছি দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে। পদ্মাকে একীভূত করা হলেও আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না, সবাই নিরাপদে থাকবেন। তিনি বলেন, বিশ্বে দুই পদ্ধতিতে একীভূত করা হয়। আমরা একুইজিশন করি নাই, মার্জ করেছি। একটা সবল ব্যাংক এবং তুলনামূলক একটু দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে মার্জ হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের মানবসম্পদ যেটা রয়েছে প্রায় ১২০০ কর্মী তাদের কারো চাকরি যাবে না। সবাই কর্মরত থাকবেন এক্সিম ব্যাংকের হয়ে। আমাদের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতি হবে না। আগের মতোই চলবে। পরিচালক নিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যাংকটি দুর্বল (পদ্মা) তারা সবল ব্যাংকের (এক্সিম) সাথে আর বসবেন না। যেহেতু এক্সিম পদ্মাকে মার্জ করেছে। আজকে থেকে পদ্মা ব্যাংক পুরোটা এক্সিম ব্যাংক হয়ে গেলো। তবে এমডি বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তারা দু’জনই ডায়নামিক আমরা চেষ্টা করব একটা ভালো সম্মাননীয় অবস্থানে তাদের রাখতে।

পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পৌনে চার হাজার কোটি টাকা ও সরকারি ব্যাংকের দায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু পদ্মাকে মার্জার করা হলো এর ফলে পদ্মা ব্যাংকের সব দায়-দেনা এখন এক্সিম ব্যাংক নিয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া দুই ব্যাংকের এ সেটও আছে। এক্সিম যেহেতু পদ্মায় জাল ফেলেছে আশা করছি আরো সবল হবে অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কোনো ব্যাংক অপর ব্যাংকে মার্জার (একীভূত) করতে হলে তিন সংস্থার (বাংলাদেশ ব্যাংক, আদালত ও বিএসইসি) সমন্বয় লাগে। ব্যাংকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা কোর্টে যাব, এরপর আমাদের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতির প্রয়োজন হবে। এভাবেই সব ব্যাংকের মার্জার প্রক্রিয়া সামনের দিকে এগোবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে উদ্যোগ নেয়। এজন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত (কোন ব্যাংক কার সাথে একীভূত হবে) নিতে পারবে একীভূত বিষয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের পর দু’টি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/822437