১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১২:৪৮

আপন শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে

-ইবনে নূরুল হুদা

গত ৭ জানুয়ারির আগে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ পশ্চিমা বিশ্ব বেশ সোচ্চার ছিল। তারা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী করার ব্যাপারে সরকারকে বিভিন্নভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসানীতিও প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু সরকার তাদের কথায় কোন গুরুত্বই দেয়নি বরং তারা নিজস্ব স্টাইলেই নির্বাচন করে আবারো তাদের ক্ষমতার মেয়াদ বনায়ন করে নিয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে পশ্চিমা বিশ্ব যে হম্বিতম্বি দেখিয়েছিল তাও নিষ্ফলা বলে প্রমাণিত হয়েছে। এক কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অনেকটা চুপসে গেছে বলেই মনে হয়েছে।

ফলে তাদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ‘লিপ সার্ভিস’-এর অভিযোগ উঠেছিল তা অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুললেও সরকারের সাথে কাজ করার প্রত্যয়ও ঘোষণা করেছে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে প্রকারান্তরে সরকারেই পালে হাওয়া দিয়েছেন বলে দৃশ্যত মনে হয়েছে। তবে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। বিরোধী দলগুলো বোধহয় সে অশায় বুকবেঁধে আছে। আর এটি তাদের জন্য আত্মঘাতী হওয়ারও সমূহ সম্ভবনাও রয়েছে। কারণ, পরাশ্রয়িতা কখনো ইতিবাচক ফল দেয় না।

তবে কিছুদিন নিরব থাকার পর অতিসম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নিরবতা ভঙ্গ করে মুখ খুলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ করেছে ইইউ-এর নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশন। তবে রিপোর্টে নির্বাচনের অনেক গুরুতর অনিয়মকে পাশ কাটানো হয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। নির্বাচনী অনিয়মগুলোকে দেখানো হয়েছে একেবারে সাদামাটাভাবে। ফলে সরকার পক্ষ একথা বলার সুযোগ পাচ্ছে যে, ‘কোন দেশেই নির্বাচন শতভাগ ত্রুটিমুক্ত হয় না। আমাদেরও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। যা নির্বাচনকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য করে তোলে না’।

প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মানদ- পূরণ করতে পারেনি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার যেমন সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন, এবং বক্তৃতা-এগুলো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেফতারের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী ও দলের সাথে যুক্ত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা ভোটারদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। মিডিয়া এবং সুশীল সমাজও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল না, সমালোচনামূলক পাবলিক বিতর্কও সীমিত ছিল। বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সাংবিধানিক সময়রেখা মেনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলো । এই নির্বাচন ছিল একটি অত্যন্ত মেরুকৃত রাজনৈতিক পরিবেশে পরিচালিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোট শরিকরা নির্বাচন বয়কট করায় সত্যিকারের প্রতিযোগিতার অভাব ছিলো। বিরোধীরা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছিলো, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়’।

‘প্রাক-নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী দলের ধারাবাহিক বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ব্যাপক সহিংসতা ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর গুরুতররূপ নেয়। পরবর্তীতে বিএনপি নেতাদের গণগ্রেফতার ও আটকের ফলে দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়। নির্বাচনের পুরো সময় জুড়ে বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। গ্রেফতার এড়িয়ে যে কোনও রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার ক্ষমতা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব ছিল। কারণ, প্রায় সব সিনিয়র নেতৃত্বকে কারাবন্দী করা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠেকাতে ফৌজদারি অভিযোগ গঠন ব্যাপকভাবে একটি কৌশলের অংশ হিসাবে অনুভূত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার অপরিহার্য, যা বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বলা আছে। কিন্তু এই অধিকারগুলো ক্ষুণœ করা হয় আইন দ্বারা যা অযথা বাক স্বাধীনতার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সমান ভোটাধিকারের নীতিকে পুরোপুরি সম্মান করা হয়নি। বিদ্যমান আসনের সীমানা নির্ধারণের ভিত্তিতে সংসদীয় আসন প্রতি ভোটার সংখ্যায় তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা মেনে চলে। কমিশনের ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। তাই তারা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দিতে সক্ষম হয়নি বলে মনে করে কিছু স্টেকহোল্ডার’ । তাদের ধারণা, ভোটদান এবং গণনা প্রক্রিয়ার সময় কমিশনের স্বাধীন মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা হয়নি’।

এতে বলা হয়, প্রাক-নির্বাচনের আবেদনগুলো সবই প্রার্থী মনোনয়ন সংক্রান্ত ছিল। প্রার্থী প্রথমে নির্বাচন কমিশনে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন। এগুলো মোকাবিলা করা হয় দ্রুতগতিতে। যদিও আন্তর্জাতিক অধিকার পূরণে কিছু ত্রুটি ছিল। বেশ কয়েকজন মন্তব্য করেছেন যে, এর জন্য খুব কম সময় দেয়া হয়েছে। এই মামলা নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, আদালত কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার দ্বারা কিছু নির্দিষ্ট মানুষ উপকৃত হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিও আস্থার অভাব ছিল। প্রচারণা এবং নির্বাচনের দিন আদর্শ আইন এবং আচরণবিধি প্রয়োগ অসঙ্গত ছিল। রিপোর্ট করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এগুলোকে অযথা নম্রভাবে মোকাবেলা করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখিয়েছে।

সাধারণভাবে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্বাচনের দিন সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং জালিয়াতির প্রচেষ্টাসহ নির্বাচন কমিশনে স্থানীয় প্রার্থীরা ভোটে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটির তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা হয়েছিল। ২৫টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। তবে অন্যান্য ঘটনা অবহেলিত ছিল এবং পর্যাপ্তভাবে তদন্ত করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটের হার ছিল ৪১.৮ শতাংশ। এটাই সারা দেশে ব্যাপক বৈষম্যের চিত্র প্রদর্শন করে। চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ফলাফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীরা ২২৩টি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি, জাতীয় পার্টি পায় ১১টি আসন। আসন ভাগাভাগির চুক্তিতে আরও দু’টি দল একটি করে আসন পেয়েছে। চূড়ান্ত আসনটি কল্যাণ পার্টি জিতেছে।

নির্বাচনী কিছু এলাকায় উন্নতির জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এসব সুপারিশ কথার কথা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। যেখানে দেশে নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই হয়নি। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া ৪১% ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। অথচ অভিজ্ঞমহল মনে করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ৫%-এর বেশি ছিল না। সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের সুপারিশ অনেকটা ‘অরণ্যে রোদন’ বলেই মনে হয়। তবে প্রকাশিত রিপোর্টের একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি। বিষয়টি সচেতন মহলে নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

এদিকে নির্বাচন পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও ভূমিকা বেশ আলোচনায় এসেছে। সবচেয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির বিষয়টি। তবে মার্কিন কূটনৈতিক সূত্র জানাচ্ছে, সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের ওপর দৃষ্টি দেয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের। ঢাকা এখনো ওয়াশিংটনের মূল্যায়নভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে রয়ে গেছে। অনলাইন ‘দ্য ফরেন পলিসি’তে বিভিন্নভাবে এ কথাটিই বলেছেন উইলসন সেন্টারে সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি ‘ফরেন পলিসির’ সাপ্তাহিক সংক্ষিপ্ত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক লেখায় এসব কথা বলেছেন। লিখেছেন, কূটনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালীকরণ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নেয়াসহ বিভিন্ন এজেন্ডাকে সামনে রেখে এ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন মার্কিন সরকারের একটি সিনিয়র প্রতিনিধিদল। এই গ্রুপে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের আইলিন লাউবেচার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক এজেন্সির মাইকেল শিফার। তাদের আলোচনায় ফোকাস দেয়া হয় জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য, রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং শ্রম অধিকার। প্রতিনিধিরা সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এক্সিকিউটিভ, নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং বিরোধী শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে বিষয়টিতে এখনো অনেকটা অস্পষ্টতাই রয়ে গেছে।

মূলত, কথার সুর এবং বার্তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্পষ্ট একটি পটপরিবর্তনের মধ্যে হয়েছে এই সফর। ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে শক্তিশালী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে আছে নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং প্রকাশ্যে সমালোচনা। অনুষ্ঠিত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি মূল্যায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যা-ই হোক, ৬ই ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’কে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে তাতে অধিকার বা গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

এ সপ্তাহে মার্কিন প্রতিনিধিদের সফরের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বাংলাদেশী কর্মকর্তারা নতুন করে পথ চলা শুরু করার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেছেন, ‘নির্বাচন এখন একটি অতীতের বিষয়’। উভয় পক্ষের মধ্যে বার্তা বিনিময় ছিল উষ্ণ এবং কার্যকর। এতে প্রচুর রেফারেন্স দেয়া হয়েছে অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করা নিয়ে। এই চিত্র গত এপ্রিলের পুরো বিপরীত। ওই সময় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। বলেছিলেন, তারা শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন করতে চায়।

এই পরিবর্তনের কারণ কি? একটি সম্ভাব্যতা হতে পারে, ঢাকাকে অভিযুক্ত করার রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রাখতে চায় ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা যতই প্রকাশ্যে মত দেন, ততই তারা এতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েন। উদাহরণ হিসেবে, গত নবেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্কে নির্দেশ করে সহিংস হুমকির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মার্কিন দূতাবাস।

বার বার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে চাপ দেয়ায় তাতে চীন ও রাশিয়া উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। তারা এটাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করতে থাকে। এই চাপে হতাশ হয়ে পড়ে ভারত। ভারত হলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী প্রচেষ্টা কার্যকরভাবে ঢাকায় সুবিধা দিয়েছে মস্কো এবং বেইজিংকে। এতে সাউথ ব্লক খানিকটা হলেও বিব্র্রত বলেই মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্যোগে ভূরাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোও ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে যুদ্ধ তীব্র হয়েছে। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের প্রত্যাবর্তন চায় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র এসব স্পর্শকাতর ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া নিশ্চিত করতে চায়। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতায় ক্রমবর্ধমানভাবে দৃষ্টি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি। অন্য যেকোনো স্থানে কূটনৈতিক মাথাব্যথা কমিয়ে আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের পরিবর্তন যতটা তীক্ষè বলে মনে হচ্ছে, আসলে ততটা তীক্ষè তা নয়। নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও সম্পর্ক এরই মধ্যে গভীর হয়েছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার চিঠিতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন কিছু ক্ষেত্রে। তার মধ্যে আছে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যু। উপরন্তু মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের ওপর দৃষ্টি দেয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আফরিন আখতার। এ সময় তিনি জেলে থাকা বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীর বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

ঢাকা এখনো ওয়াশিংটনের মূল্যায়নভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে রয়ে গেছে। তবে এ নিয়ে পরীক্ষা বর্তমানে কম কঠোরতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি চাপ নয়, সম্পর্কের সুর এবং বার্তা জোরালোভাবে ইতিবাচক ও কার্যকর মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এতে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, আপাতত যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে-কৌশলগত গুরুত্ব হলো বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মসৃণ সম্পর্ক বজায় রাখা। যা আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। তবে একথাও সত্য যে, একটি বাজে ও বিতর্কিত নির্বাচন করার পর সরকারও খুব একটা স্বস্তিতে নেই বরং তাদের মধ্যে রীতিমত আত্মবিশ^াসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ পশ্চিমা বিশ^ কখন কোন নীতি গ্রহণ করে তা নিয়েও সরকারের মধ্যে রীতিমত অস্থিরতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও সরকারের গণভিত্তির দুর্বলতা। এমন একটি সরকারের সাথে আন্তর্জাতিক বিশে^র সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে সরকার এ বিষয়ে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলগুলোর অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভরতা তাদেরকে ডুবিয়েছে। তারা আপন শক্তিতে বলীয়ান না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভর করা খুব একটা ইতিবাচক হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছিল সেসব বিরোধী দলের পালেই হাওয়া দিয়েছিল। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য যে, এসব সুযোগ তারা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। এমনকি এক্ষেত্রে তারা অতিআত্মবিশ^াসী হয়ে শরীক দলগুলোকে অবলমূল্যান করতে কসুর করেনি। যা সরকারের অবস্থানকেই অধিক সুবিধা দিয়েছে। আর বিদেশী শক্তি যে কাউকে হাতে ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় না তাও এবার দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি বিরোধী দলগুলোর আত্মসমালোচনার দাবি রাখে।

তাই দেশে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী দলগুলোকে অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভরতার পরিবর্তে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আগামী দিনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। যেকোন আন্দোলনে জনগণকে সক্রিয় করা না গেলে সে আন্দোলন সফল হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধী দলের উচিত রাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী বললো এটা তেমন বিবেচ্য বিষয় নয় বরং বাস্তবতা উপলব্ধিই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।

https://www.dailysangram.info/post/551376