১৪ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:২৯

জিম্মি নাবিকদের আকুতি

‘আমাদের বাঁচান’

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ অপহরণের দু’দিন পার হচ্ছে। এখনো দস্যুদের কারও সঙ্গে জাহাজের মালিকপক্ষ এস আর শিপিং কর্তৃপক্ষ বা সরকারের কেউ যোগাযোগ করতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নিজেদের জিম্মায় থাকা জাহাজটি নিয়ে সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছার পর মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন জলদস্যুরা। এরমধ্যে বাঁচার আকুতি জানিয়ে জাহাজের নাবিক ও ক্রুদের আকুতির বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপ এসেছে গণমাধ্যমে।

জলদস্যুদের হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর চিপ অফিসার আতিকউল্লাহ খান চট্টগ্রামে মালিকপক্ষের কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠান। সেখানে কীভাবে জাহাজটি দস্যুদের কবলে পড়ে তার বর্ণনা দেন। একই সঙ্গে বারবার বাঁচার আকুতি জানান। আতিকুল্লাহ বলেন, ‘তখন সকাল সাড়ে ১০টা। গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টা)। ওই সময় একটা হাই স্পিডবোট আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দিই।

আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা চলে এলো। তারা ক্যাপ্টেন ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করলো। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এ সময় একটা স্পিডবোটে আরও কয়েকজন চলে এলো। এভাবে ১৫-২০ জন এলো জাহাজটিতে। কতক্ষণ পর একটি বড় ফিশিং ভেসেল এলো। ওটা ছিল ইরানের মালিকানাধীন মাছ ধরার জাহাজ, যেটিকে এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। মাছ ধরার জাহাজটি দিয়ে তারা সাগরে জাহাজ খুঁজছিল। এখন ওই মাছ ধরার জাহাজ ছেড়ে দেবে। তবে সেটির জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। এখন আমাদের থেকে ডিজেল নিচ্ছে। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন, স্যার। সান্ত্বনা জানাবেন।’

চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কবির স্টিলসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজ। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে অবস্থান করা জাহাজটির ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ চট্টগ্রামের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, জলদস্যুরা তাদের জাহাজে আক্রমণ করেছে। ওই সময় কর্মকর্তারা সেই আক্রমণ যে কোনো মূল্যে ঠেকানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ই-মেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে। জানা যায়, ভারত মহাসগরে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখে জলদস্যুরা। বিকাল পাঁচটার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা ডলারও। ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরের সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটির যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন দিন। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।

এদিকে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজটির নাবিক ও ক্রুদের পরিচয় মিলেছে। তাদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। আর নাবিকদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির সাতজন সাবেক ক্যাডেট রয়েছেন। এরা হলেন- চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন এবং ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান। জাহাজটিতে আরও রয়েছেন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ এবং ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ। এছাড়া ক্রু হিসেবে রয়েছেন এবি আনোয়ারুল হক, আসিফুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, নাজমুল হক ও আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ও আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক শফিকুল ইসলাম, জিএস নূর উদ্দিন এবং ফিটার সালেহ আহমেদ।

এদিকে দস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজটিতে ২০-২৫ দিনের মতো খাবার আছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি রয়েছে ২০০ টন। তবে দাহ্য হওয়ায় জাহাজে পরিবহনরত ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান অডিও বার্তায় জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিং’র কর্মকর্তাদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। আতিকউল্লাহ খান বলেন, ‘প্রক্সিমেটলি ২০-২৫ দিনের প্রোভিশন (রসদ) আছে স্যার। ২০০ মেট্রিক টন ফ্রেস ওয়াটার আছে। আমরা অলরেডি সবাইকে বলছি ফ্রেস ওয়াটার সেফলি ব্যবহার করতে। প্রোভিসনও (রসদ) আমরা ওভাবে হ্যান্ডেল করবো।’ জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা প্রবলেম হচ্ছে, আমাদের জাহাজে কোল কার্গো আছে। অ্যাবাউট ফিফটি ফাইভ থাউজ্যান্ডস। এটি একটু ডেঞ্জারাস কার্গো, এটা হেজার্ড আছে। এটার মিথেন কনসেনট্রেশন বাড়ে। সর্বশেষ অক্সিজেন লেভেল ৯-১০ পার্সেন্ট ছিল। এটা রেগুলার আপডেট নিতে হয়। ইনক্রিজ হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন।

এদিকে মঙ্গলবার রাতেই দস্যুরা নাবিকদের থেকে মোবাইলসহ সব ডিভাইস নিয়ে ফেলায় তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে থাকা শিপিং কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে একজন নাবিক গোপনে ওয়াশরুমে লুকিয়ে রাখা মোবাইল থেকে বুধবার সকালে বাংলাদেশে কথা বলেন। সেই নাবিক জানান, জাহাজের সবাই ভালো আছেন। কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আজকেও আমরা জাহাজের এক নাবিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন।’ তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে জলদস্যুরা মুক্তিপণ দাবি করেছেন। তবে এটা সত্য নয়। তাদের সঙ্গে আমাদের এখনও যোগাযোগই হয়নি। কাজেই মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টি আসবে কেন?

মিজানুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন মেরিটাইম সূত্র ব্যবহার করে দস্যুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পাইনি। জলদস্যুরাও এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা পাঠায়নি। তবে আগেও যেহেতু এসআর শিপিং এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও তারা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশা রাখছে। এদিকে বুধবার দুপুরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক যৌথসভায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। নাবিকরা এখনও নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। তবে জাহাজ এখন জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিপিং ব্যবস্থা এখন বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমরা যখন এ বিষয়টি অবহিত হয়েছি, তখন তাৎক্ষণিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আন্তর্জাতিক যতগুলো উইং নৌ পরিবহনের কাজ করে, সবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। নৌবাহিনীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অনেক বেশি, আমরা তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি।’

নাবিকদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে কতদিন লাগতে পারে এ প্রশ্নে নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। জলদস্যুদের সঙ্গে থেকে কখন তারা মুক্তি পাবে সেটা বলা মুশকিল। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সুস্থভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা কাজ করছি। তবে নির্দিষ্ট করে সময় বলা যাচ্ছে না।’ প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কবির স্টিলসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকা ২৩টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন এমডি আব্দুল্লাহ। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। এর আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক। ২০১০ সালের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘জাহান মণি’ নামে একটি জাহাজ আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। দস্যুরা তখন জাহাজের ২৫ জন নাবিকসহ মোট ২৬ জনকে জিম্মি করে। প্রায় ৩ মাস পর ২৮ কোটি টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা দস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পান।

https://mzamin.com/news.php?news=101627