১২ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ১:৫৩

সাত কোটি টাকার গমবীজ নষ্ট

ক্রয় করা হয়নি পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগ

সময়মতো গমবীজ সংরক্ষণে পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগ ক্রয় না করায় ৪৬ লাখ ৩২ হাজার ৭৫৫ কেজি বীজ অবীজে পরিণত হয়েছে। বাজার মূল্যে প্রায় ৭ কোটি টাকার বীজ অবীজে পরিণত হয়েছে এবং ক্রয় মূল্যের চেয়ে অর্ধেকমূল্যে গমগুলো বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) প্রায় ৭ কোটি টাকা গচ্চা গেছে বলে জানা গেছে। সংস্থাটির ক্রয় বিভাগের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিতে এ ঘটনা ঘটেছে।

বীজ প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ বিভাগ (বীপ্রস) থেকে বীজ সংরক্ষণে বিশেষায়িত এ ব্যাগ কেনার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও সংস্থাটির ক্রয় বিভাগ সময়মতো ব্যাগ সরবরাহ করতে পারেনি। ফলে পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগের অভাবে গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলা পর্যায়ে ডিলারদের বীজ সরবরাহ করতে পারেনি বিএডিসি। এতে বিএডিসির বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে অবিক্রীত থেকে যাওয়া বীজের পরিমাণ ২ হাজার ৫৮১ দশমিক ৯০০ মেট্রিক টন, বিভিন্ন বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে থেকে যাওয়া বীজের পরিমাণ ২ হাজার ৫০ দশমিক ৮৫৫ মেট্রিক টন। সর্বমোট ৪ হাজার ৬৩২ দশমিক ৭৫৫ মেট্রিক টন গম অবীজে পরিণত হয়। ওই বীজ আর উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয়নি। কেনা দামের অর্ধেকমূল্যে সাধারণ গম হিসাবে বিক্রি করতে হয়েছে সংস্থাটিকে।

বিষয়টি নিয়ে বিএডিসির ক্রয় বিভাগ ও বীজ প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ বিভাগ (বীপ্রস) একে অপরকে দুষছে। বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও বিলম্বে ব্যাগ কেনায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন বীপ্রস বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা ক্রয় বিভাগের গাফিলতিকে এককভাবে দায়ী করেন। বিএডিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বশেষ যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিলম্বে পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগ কেনা হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে গিয়ে সংস্থাটির বিপুল অর্থ গচ্চা গেছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তি মোতাবেক ব্যাগ সরবরাহ করতে না পারায় তার জামানত বাতিল হবে এবং বিল পাওয়ার কথা নয়। সরবরাহকারীর সঙ্গে ব্যাগ ক্রয় চুক্তি করেছে ক্রয় বিভাগ। সুতরাং ক্রয় বিভাগ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কী ব্যবস্থা তারা নিয়েছেন তা বীপ্রসকে জানায়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান,সংস্থাটি এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে বোরো, গম ও ভুট্টা বীজ ক্রয় করে সংগ্রহ করেছে। নভেম্বর মাসের শুরু থেকে সংগৃহীত বীজ সরকারিভাবে জেলা ও উপজেলায় ডিলারদের কাছে পাঠায় সংস্থাটি। ১০ কেজির ব্যাগে ধানের বীজ এবং ২০ কেজির ব্যাগে করে গমের বীজ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় পাঠানো হয়। কারণ নভেম্বর মাস থেকে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়। নভেম্বর মাসে শেষের দিকে গমের বীজ লাগানো হয়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে গমের বীজ নভেম্বর মাসেই বপন করা হয়।
সংস্থাটির বীপ্রস বিভাগ থেকে গত বছর ২১ মার্চ থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট চারটি পত্রে বীজ সংরক্ষণে ব্যবহৃত পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগ সরবরাহের তাগিদ দেওয়া হয়। প্রতিটি পত্রেই বলা হয়, বীজ একটি সংবেদনশীল দ্রব্য। সংরক্ষণে কোনো ধরনের গাফিলতি হলে বিনষ্ট হয়ে তা অবীজে পরিণত হয়। এতে দেশের কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। গত ১২ সেপ্টেম্বর বীপ্রস বিভাগ থেকে বিক্রয় বিভাগে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গমবীজ সরবরাহ না করা হলে দেশে খাদ্য উৎপাদন বিঘ্নিত হবে।
সেক্ষেত্রে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ৭ লাখ পলিকোটেড হেসিয়ান জুট ব্যাগ সরবরাহের অনুরোধ করা হলো। তারও আগে ১ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির বীজ অনুবিভাগের এক পত্রে বলা হয়, গমবীজ জেলা-উপজেলায় বিতরণকাল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সময়মতো বিতরণ করা না হলে গমবীজ অবিক্রীত থেকে যাবে। গম উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বিএডিসি তথা দেশের ক্ষতি হবে। সেক্ষেত্রে ২০ অক্টোবরের মধ্যে সাত লাখ ৫০ হাজার হেসিয়ান পলিকোটেড জুট ব্যাগ সরবরাহের তৃতীয়বার অনুরোধ করা হলো। কিন্তু ২০ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ব্যাগ ক্রয় বিভাগ সরবরাহ করতে পারেনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ব্যাগ ক্রয়ের জন্য বিএডিসি ১০ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করলে একাধিক প্রতিষ্ঠান তাতে অংশগ্রহণ করে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর পুনঃদরপত্র করা হয়। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ফলে ব্যাগ পাওয়া যায়নি।
এদিকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিয়াম টেক্সটাইল অ্যান্ড জুট ২৬ নভেম্বর ২০ কেজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাগ সরবরাহে কোনো প্রকার খেসারত বা জরিমানা ছাড়াই ৩৫ দিন সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। নির্ধারিত সময়ে ব্যাগ সরবরাহে কোনো সমস্যা থাকলে ২১ দিন আগে বিএডিসিতে সময় বাড়ানোর আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সরবরাহের তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর ৩৫ দিন সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে।

আবার আবেদন পাওয়ার পর ২১ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা। বিএডিসির ক্রয় বিভাগ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সরবরাহের সময় বাড়ানোর আবেদন নিষ্পত্তিতে এক মাসের বেশি সময় নিয়েছেন। সিয়াম টেক্সটাইল অ্যান্ড জুটকে বিনা খেসারতে বা জরিমানায় জুট ব্যাগ সরবরাহের সময় বাড়িয়ে দেওয়া চিঠিতে মহাব্যবস্থাপক মো. তুহিনুজ্জামান স্বাক্ষর করেছেন গত ২৫ জানুয়ারি। উল্লেখ্য, ৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখের মধ্যে জুট ব্যাগগুলো সরবরাহের কথা ছিল।

এসব অনিয়মের বিষয়ে বিএডিসির ক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. তুহিনুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) জানান, আপনি পাবলিক রিলেশন অফিসারের (পিআরও) সঙ্গে কথা বলেন। স্যার কথা বলবেন না। বিএডিসির পিআরও এসএএম সাইব যুগান্তরকে বলেন, আমার কাছে তো কোনো বিষয় বলা নেই। আমার কাজ বিজ্ঞাপন দেওয়া ও পেপারকাটিং করা এবং কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করা। তবে আপনার প্রশ্নগুলো আমাকে দেন এবং আমি জেনে পরে জানাব।

সংস্থাটির পরিচালক ও সদস্য বীজ মো. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বীজ বিক্রি হয়নি এবং বীজ অবীজে পরিণত হয়েছে এটা সত্য। এতে সংস্থার লোকসান হয়েছে এটাও সত্য। তবে এ সমস্যা এককভাবে জুট ব্যাগের কারণেই হয়েছে তা কিন্তু নয়। আরও অনেক কারণের মধ্যে জুট ব্যাগ একটি সংকট হতে পারে। কারণ কম দামে ব্যাগ ক্রয় করতে গিয়ে বারবার দরপত্র করতে হয়েছে। একদিকে কম দামে ব্যাগ কেনা গেছে অন্যদিকে সঠিক সময়ে ব্যাগ পাওয়া যায়নি। এতে সংকট তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও জানান, গমের চাষ দেশে কমে গেছে সে কারণেও বীজ নষ্ট হয়েছে। তাহলে বেশি বীজ গম কেনা হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, আমরা চাইলে বীজ বেশি বা কম ক্রয় করতে পারি না। বীজ কেনার ক্ষেত্রে জাতীয় বীজ বোর্ডের সুপারিশ আমলে নিতে হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/783713