১২ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ১:১২

রমজান ঈদ এবং মূল্যবৃদ্ধি

-মোহাম্মদ আবদুল মাননান

নরওয়ে আইনকানুন মানার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশের মধ্যে একদম প্রথম দিকে। রাস্তা বা স্টেশনে লাগেজ ফেলে এলেও সমস্যা নেই; পুলিশ তুলে নিয়ে ট্যাগ বা কিছু একটা খুঁজবে, দেখবে, মালিকের হদিস পাওয়া যায় কি না। দেশটার শপিংমলেও লাইনে দাঁড়াতে হয়- একজনও সেটা ভঙ্গ করে না। কিন্তু ক্রিস্টমাস ডে বা এমন কোনো জাতীয় পার্বণে কিছু কিনতে লাইন ভঙ্গ করা যায়। এই সময়ে সব জিনিসের দামে বেশ-একটা ছাড় থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে প্রায় সব উন্নত দেশেই মূল্য ছাড়ের রেওয়াজ আছে- সবাই অপেক্ষায় থাকে এই দিনের জন্য। ওই সময়ে বিক্রিও বেশি হয়। আমাদের এখানেও আগে ছিল, ‘বেশি বিক্রি করো, কম লাভ করো’। কিন্তু এখন উল্টো পথেই চলছি যেন। ঈদ-পুজো বা অন্য কোনো উৎসব এলেই দাম বৃদ্ধির প্রবণতা; এ যেন রেওয়াজ বা নিয়মে রূপ নিয়েছে। আবার প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ানো হলো, কিন্তু উৎসবটি শেষ হলেও আর কমার নাম নেই- এই-ই আমাদের বাজারব্যবস্থার একটি চেনা চিত্র। এই চিত্র মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তরও নেই।

রমজানে কিছু দ্রব্যের চাহিদা খানিকটা বেড়ে যায়। মা’শাআল্লাহ, রোজার আগমনেই সেসবের দাম বেড়ে যায়। বৃদ্ধির কোনো কারণ থাকে না। রমজানে ব্যবহার্য দ্রব্যাদির আমদানিও বাড়িয়ে দেয়া হয়। তার পরও দাম বাড়বেই- এ এক অলিখিত দলিল। যা দেশে উৎপাদিত হয়, তারও দাম বেড়ে যায়। আবার সদাশয় সরকার এই রমজানে কিছু দ্রব্যের শুল্ক হ্রাস করে ভোক্তাদের কথা ভেবে, অথচ বাজারে তার কোনো প্রভাবই নেই। অথচ ধর্মীয় মতে, এই রমজানে ভালো ভালো কাজ করার একটি মোক্ষম মাস। কিন্তু আমজনতার কষ্টের কথা মাথায় রেখেই রমজান ও দুই ঈদে প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয় আর সেটা কৃত্রিম উপায়েই। রমজান আসার আগেই এসবের পুনরাবৃত্তি। শুরুর আগেই চিনি, ছোলা, বেগুন, মুরগি, অ্যাংকর ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেল ইত্যাদির দাম বেড়ে গেছে। গেছে তো গেছেই- রমজান শেষ, চাহিদাও খানিকটা কম, কিন্তু দাম আর পড়ে না। এমন অদ্ভুত দেশ আর কোথায়! এমনকি এসব দুর্বৃত্ত-অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারও ঠিকঠাক পেরে উঠছে না। এমন দেশ কোথায় আছে আর?

ঈদ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই রমজানের কথা আসে। রমজানের প্রসঙ্গ মানেই সাধারণ আর হতদরিদ্রের কষ্টের কাসুন্দি; কাঁহাতক আর? প্রকৃত রোজা পালনকারীদের জন্য ঈদ আদতেই খুব খুশির দিন। হজরত ওমর (রা:) বলেছেন, যারা রোজার মাসে তাদের পাপ মওকুফের দোয়ায় মশগুল ছিল, ঈদ তাদের জন্য অতি আনন্দেরই। শিশুদের জন্যও এটি বিশেষ আনন্দের দিন। হতদরিদ্ররা এই সময়ে কিছু দান-দক্ষিণা পেয়ে থাকে, ফলে তারাও ঈদের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি অতিধনী ব্যতিরেকে সবাইকেই বিপর্যস্ত করে দেয়। এতে কারো কারো জন্য ঈদের আনন্দই মাটি হয়ে যায়। কতক আবার বিরসচিত্তে ঈদ পার করে দেয়- হয়তো বাচ্চাদের তেমন কিছুই দিতে পারে না- অথচ ঈদে নতুন কাপড় পরার গুরুত্ব আছে ইসলামে এবং আমাদের দেশে ঈদে-পুজোয় নতুন কাপড় পরা যেন এক সামাজিক প্রপঞ্চ হয়ে আছে। রমজান আর ঈদে কেবল খাদ্যদ্রব্যের মূল্যই বেড়ে যায় না, বৃদ্ধি পায় কাপড়-চোপড়ের দামও। যদিও এক রমজান মাসে যে বিক্রি হয়, তা প্রায় সারা বছরের সমান। কথাি ছল, এই সময়ে দাম হ্রাস পাবে। হচ্ছে উল্টোটা। আছে ঠকানোর প্রবণতাও। ১২ শত টাকার একটা কিছু সাতাশশো লিখে ৫০% মূল্য ছাড়; কী দাঁড়াল? এটি সম্ভবত এই দেশেই হয়। একই দ্রব্য পাশাপাশি দোকানে অনেক ব্যবধানে বিক্রি হয়- একটু দেখে না নিলে আপনি নিশ্চিত ঠকবেন, হলফ করেই বলছি এ কথা।

জানেন তো, এই রমজানে চাঁদাবাজিও বেড়ে যায়। সামনে ঈদ যে! সাধারণ মানুষের জন্য রমজান মাসে কপালে জোটে মূল্যবৃদ্ধি। সরকারি চাকুরেরা এই সময়ে উৎসব বোনাস পায়। আবার ঘুষও এই সময়ে বেড়ে যায়। এই ঘুষ আবার বকশিশ নাম ধারণ করে। অফিসের বড় সাহেবরা ছোট কর্মচারীদের ওই ঘুষ থেকেই কিছুটা বকশিশ আকারে বিতরণ করে। আরো মজার হলো, ঈদের আগে নানা বিল-টিল প্রদানের হারও বেড়ে যায়। রমজানের শেষ পক্ষে অফিসপাড়ায় টিকাদারদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পায়। বিলপ্রাপ্তি। সেখান থেকেই পারসেন্টেজ। সেখান থেকে ছোট কর্মচারীদের বকশিশ; এক অলিখিত প্রথায় আক্রান্ত আমরা। যার বা যাদের এসব নেই কিংবা অভ্যস্ত নয়, তাদের একটু বিপদই বটে। কেননা এক গাড়ির চালক তো পাশের গাড়ির চালককে এসব ফেরি করে বেড়ায়।

কোথাও আবার অফিসের বসদের এই সময়ে খুশি করার বন্দোবস্ত আছে। উপজেলার অফিসার জেলার বসকে, জেলার বসকে আরো উপরের দিকে। কোনো কোনো বস আবার এভাবে বকশিশ নিয়ে অধঃস্তনদের অকাতরে ঈদের উপহার বিলান। প্রশংসা কুড়ান। এই কাজে কেউ ব্যবহার করেন এলআর বা ইউনিট ফান্ড। ফলে চাঁদাবাজিও বেড়ে যায়।

বছর বিশেক আগের কথা- রেঞ্জের ডিআইজি ঈদুল ফিতরের তিন-চার দিন আগেএসপিদের মিটিংয়ে ডেকেছেন। এক বেরসিকজন পরিচিত পুলিশ অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, ঠিক এই সময়েই কেন? জবাব এসেছিল, আপনি তো বেশ বোকা, সামনে ঈদ, ভুলে গেছেন?

ঈদ মানেই শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, সার্বিক অর্থে নিরেট আনন্দের দিন, একটি প্রধানতম জাতীয় উৎসব। সবারই আনন্দ করার দিন- ধর্মীয় উৎসবে সীমিত না থেকে জাতীয় উৎসব হয়ে আছে সেই আবহমান কাল থেকেই। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল, পোশাকের আকাশচুম্বী হাঁকডাক- ঈদকে কেমন যেন পানসে করে দেয় প্রতিবার। এছাড়া কারোর বিচার-পূর্ব কারাবন্দিত্ব, কোনো পরিবারের জন্য ভয়াবহ দুর্ঘটনা, কারোর অসুস্থতা, যথাসময়ে বেতন-ভাতা না পাওয়া, কাজের অভাবে আয়ে ধাক্কা ইত্যাকার কারণগুলো কারো কারো জন্য ঈদ-আনন্দের চেয়ে দিনটি কষ্টের হয়ে যায়। এই বছর একটু ব্যতিক্রম চাই। এই রমজান-ঈদে চাইব, রমজান পালনের মধ্য দিয়ে সবাই ত্যাগ-তিতিক্ষায় আরো উদ্বুদ্ধ হই এবং সবার ঈদের আনন্দে সমান না হোক, নিজের মতো করে উপভোগ করতে সক্ষম হই। আমি ব্যবসায়ী হলে এই রমজান আর ঈদকে পুঁজি করে প্রথাবিরোধী পথে ব্যবসা না করি। প্রত্যাশা করব, ঈদের ছুটিতে পথ দুর্ঘটনায় কারোর জীবনহানি না হোক, স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়াও একটি মৃত্যুও না হোক এইবারের ঈদে। যথার্থ অর্থেই আসন্ন ঈদ-উৎসব সবার জন্য অনাবিল আনন্দ বয়ে আনুক। এই একটি দিনে কারো দুঃখ কষ্ট না থাকুক।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/820573