১১ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ১২:৪৪

কেবলই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস

-সালাহউদ্দিন বাবর

এটিই সঠিক, যেখানে এক্সপেকটেশনটা যত বেশি, সেখানে মানুষের এক্সপেকটেশনটাও স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে উপরেই থাকে। সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ডা: সামন্ত লাল সেন দেশের খ্যাতিমান একজন চিকিৎসক। তার কৃতিত্ব অনেক বলেই বিভিন্ন মহলে গ্রহণযোগ্যতা তার বেশি হতে পারে। সে জন্য তার কাছ থেকে মানুষ বাড়তি কিছু চাইতে পারে। ডা: সেনের হাতে এবার সোপর্দ করা দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার এক বিরাট দায়িত্ব। দেশবাসী জানেন, এখানকার মানুষ শুধু ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে দিন গুজরান করছে না, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এতটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে; যা বলার নয়। যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা। ওষুধের মূল্য, পথ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যা অনেকের সাধ্যের বাইরে। গুণীজনরা বলেন, পথ্যই ওষুধ, ওষুধ পথ্য। এ দুটোরই মারাত্মক টানাপড়েন আছে। তা নিয়ে বহু মর্মবিদারক কাহিনীর কথা শোনা যায়। এই পটভূমিকে বিবেচনায় নিয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলতে হচ্ছে। এর সর্বাঙ্গে এমন ঘা মলম দেয়া হবে কোথায়! ডা: সেন এখন দেশের এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছেন।

ভঙ্গুর বা ভেঙে পড়া চিকিৎসাব্যবস্থাকে সহসা মেরামতের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া খুব সহজ নয়। সবাই জানেন, কত ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডা: সেনের পূর্বসূরি তিনিও একজন চিকিৎসক ছিলেন। সেই পূর্বসূরির দায়িত্ব পালন নিয়ে অনেক কুকথা আছে। তিনি নাকি বহু কুপ্রথা অনুসরণ করে বেসুমার কুকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন বলে দুর্মুখদের এন্তার অভিযোগ। দুর্মুখদের অভিযোগগুলোর মধ্যে যদি সারবত্তা থেকে থাকে, তাহলে তার সব দুর্বলতার দায়িত্ব কেন তিনি একা বহন করবেন। তিনি তো আর জবরদস্তি করে দায়িত্ব কাঁধে নেননি। তাকে ‘চয়েস’ করা হয়েছে। সেখানে কোনো ব্যত্যয় থাকলে ভিন্ন কথা। যেহেতু বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তাই এ নিয়ে আর কথা বলা সময়োচিত হবে না। স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। এখন কথা ঘুরিয়ে বলতে হবে- স্বাস্থ্যই এই জনপদের মানুষের অন্যতম কষ্টের কারণ। এ থেকে পরিত্রাণের পথ কুয়াশাচ্ছন্ন বলে মনে করা হয়। যাই হোক, এই ডা: সেন মাত্র দায়িত্ব নিয়েছেন- তার সব কিছু জানতে হবে, বুঝতে ও গোছাতে সময় লাগবে। তার পরই তার মূল্যায়ন হতে পারে। তাই শেষ কথা বলার সময় সম্মুখে থাকবে। তবে তিনি ছুটছেন।

তবে ডা: সেনের মন্ত্রণালয়টি খুব জটিল। বিশেষ করে অন্যান্য সহযোগী মন্ত্রণালয়ের অনেক ব্যত্যয়ের দায়ভার তার মন্ত্রণালয়ের ওপর এসে পড়ে। যার জন্য প্রস্তুত থাকার সময় থাকে না। সেই ব্যত্যয় নিয়ে পরে কথা বলা যেতে পারে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা যে ভঙ্গুর অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। সে ব্যাপারেই এখানে দু-একটি কথা বলা যেতে পারে। বহুকাল থেকে দেশে শিশুদের খতনার ব্যবস্থাটি করে আসছে অশিক্ষিত কিছু ব্যক্তি। তাদের এ নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা থাকলেও কোনো প্রশিক্ষণ কখনোই ছিল না। তাদের কাজ নিয়ে খুব একটা অভিযোগ কখনোই শোনা যায়নি। কিন্তু হালে দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দু’জন ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের হাতে খতনার সময়। এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন হতে পারে। যে প্রশ্নই হোক, সব কিছুর কেন্দ্রে থাকবে দেশের চিকিৎসকদের নিয়ে। দোষ হয়তো দু’জনের কিন্তু এখন সেটি সব চিকিৎসককে স্পর্শ করতে পারে, সেটি ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে সবাই জানেন, দেশে বহু দক্ষ, যোগ্য ও উচ্চমানের চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের অনেকেরই অসাধারণ কৃতিত্বের কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু তাদের অনেকেই ভুলও বোঝেন। সেসব স্বনামখ্যাত চিকিৎসক নিজে কর্মদক্ষতা নিয়ে নিজের ডঙ্কা নিজেই বাজাতে পারেন না। অথচ তাদের প্রচার হওয়া দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন অনস্বীকার্য। দেশ থেকে বহু লোক বাইরে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এ বাবদ স্রোতের মতো টাকা দেশের বাইরে চলে যায়, যাচ্ছে। আমাদের ভালো মানের চিকিৎসকদের এখন ‘ওভার জব’ করতে হচ্ছে। তারা সবাই হয়তো সে জন্য যথাযথভাবে সময় দিতে পারেন না রোগীর পেছনে। আর এ পরিসংখ্যানও অনেকেই জানেন, দেশের দুই হাজারের বেশি মানুষের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। রোগী চিকিৎসকদের এই অসম হার এমন পরিস্থিতি ‘বিভার্স’ করতে না পারলে দিন দিন সঙ্কট আরো বাড়বে। রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার সংখ্যাও বাড়বে, দেশের অর্থ বাইরে যাওয়ার স্রোত আরো বেগবান হবে। তবে চিকিৎসক বৃদ্ধির জন্য কোনো ‘শর্টকাট’ পথ ধরলে তার পরিণতি হবে ‘নিছক’ খতনা করতে শিশুমৃত্যুর হারসহ অন্য রোগীদের অপচিকিৎসা হতে বাধ্য। ডা: সেন সরেজমিন দেখেছেন, বড় শহরের বাইরে উপজেলায় চিকিৎসকদের কর্মস্থলে খুঁজে পাওয়া যায় না। এটি সত্য, তবে অবশ্যই এটা মুদ্রার একটি পিঠ মাত্র। অপর পিঠে রয়েছে দেশ একজন গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকের উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার এবং পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার জন্য সেই পরিবেশ কি রচনা করা গেছে? এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক প্রাসঙ্গিক এবং বিবেচনার দাবি রাখে, সন্দেহ নেই। অবশ্যই একটি উপায় বের করতেই হবে। কেননা, প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকদের নিয়ে বাস্তবভিত্তিক ভাবনা মাথায় নিতে হবে জরুরিভাবে। সবার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, গ্রামের যে সন্তান সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হয়ে শহরে ছোটে, সেখানে শহরের চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্র্যাজুয়েট কি খুব সহজেই শহর থেকে দূরে যেতে চাইবেন।

সবাই জানেন অনেক উটকো ঝামেলায় প্রতিনিয়ত পড়তে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। যেমন সবাই জেনেছে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে সাত বছর। কিন্তু কেন? এ জন্য কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়ী? দেশের ভয়াবহ বায়ুদূষণ, পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, নদীর পানি দূষিত হয়েছে, হচ্ছে। অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক আসে। এসব কারণে প্রতিদিন শত শত মানুষ মারাত্মক সব রোগ নিয়ে চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে ও হাসপাতালে যাচ্ছে। সেখানে এমন রোগীর সুচিকিৎসা দেয়া খুব কঠিন হয়ে উঠেছে লোকবলের অভাবে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার দায় কি একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। কেউ আর অন্য সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করছে না কেন। সেই সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় দিব্যি দিবানিদ্রায় নিমগ্ন। কারো চলন বলনে কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই। আর একটি বিষয়, সুচিকিৎসার জন্য সরকার কতটুকু অর্থ দিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে। তার হিসাব কষলে দিশাহারা হতে হবে। সবাই জানেন দেশের টাকা পাচার হচ্ছে, ব্যাংক লোপাট হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা মাত্র গুটিকতক ঋণখেলাপিদের পেটে। এ নিয়ে কোনো কথা হয় না। কিন্তু মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার কোনো অর্থ নেই সেটা কারো মাথা ব্যথা আছে কি? এত গভীর বেদনার বিষয় কিন্তু তার সুরাহা করবে কে? সবাই এই সমস্যা এর ঘাড়ে ওর ঘাড়ে ফেলেই নিস্তার পেতে চান। অথচ কেউই ভাবেন না জনগণ কিভাবে নিস্তার পাবে। তাদের যন্ত্রণা লাঘব করবে কে! প্রতিটি দেশ তার জনগণের অন্তত পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণে গলদঘর্ম। আর এখন সবাই গলদঘর্ম, কিভাবে তার একান্ত চাহিদা পূরণ হবে। এটিই এ দেশে দুর্ভাগ্য।

বেইলি রোডের আগুনে পুড়ে বহু লোক মরেছেন এবং আগেও এমন দুর্ঘটনায় বহুজন মারা গেছেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন। এ জন্য দায়ী কে? এই ঝুঁকির জন্য কি পূর্ত মন্ত্রণালয়সহ বহু সংস্থাই দায়ী নয় কি! অথচ যারা এসব কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে যান, সেখানে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হয়। আসলে এসব কাণ্ড হচ্ছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রয়াস। আসলে দেশের গোটা ব্যবস্থা এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা পর্যায়ে। আবার সেই কথায় ফিরতে চাই- দেহজুড়ে ঘা, মলম দেবেন কোথায়। তার পরও তো মলমটা দিতেই হবে। মলমটা সবার হাতের কাছে থাকতে হবে। কিন্তু তার জোগান দেবে কে! হেলাফেলা করে অনেক বেলা গেছে। সেই সাথে মানুষের কষ্টের সীমাও এখন দিগন্ত ছুঁতে চলেছে।
ndigantababar@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/820092