৮ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৭:১১

পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত, উদ্বেগে ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক বিষয় মূল্যায়ন করতে তদন্ত শুরু করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাঁচ দেশের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি)। ১১ই মার্চ এ বিষয়ে ওয়াশিংটনে একটি শুনানি হবে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। এসব বিষয় তুলে ধরতে ইতিমধ্যে মার্কিন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত করবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তানও এর আওতায় রয়েছে। এ ছাড়া, এশিয়ার কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়াও রয়েছে এর আওতায়।

সূত্র আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশগুলো কীভাবে অবস্থান করে নিয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখবে ইউএসআইটিসি। এ ছাড়া, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পোশাক খাতের পরিস্থিতিও মূল্যায়ন করতে চায় ইউএসআইটিসি।

এক কূটনীতিক বলেন, পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। যদিও কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ বেশ কমেছে। এরপরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির বাজারে দখল করে রেখেছে।

কিন্তু কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারে এই দেশগুলো প্রতিযোগিতা করছে? সেটা খতিয়ে দেখতে এবং একইসঙ্গে এসব দেশের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশসহ সামগ্রিক বিষয় মূল্যায়ন করতে তদন্ত শুরু করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ই মার্চ। শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিজিএমইএ তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে। এক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিকভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে। শুনানির পর আগামী ২২শে মার্চ পর্যন্ত লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ থাকবে। আর আগামী ৩০শে আগস্ট কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করবে।

গত বছরের (২০২৩) নভেম্বরের মাঝামাঝিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বাইডেন প্রশাসনের নতুন শ্রম নীতির ঘোষণা দেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বিশ্ব জুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে, তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন শ্রম নীতির ঘোষণার পর ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়ে তাদের শঙ্কার কথা জানায়।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে যে হারে উৎপাদন খরচ বেড়েছে সে হারে ক্রেতারা মূল্য দিচ্ছে না। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সামগ্রিক কর্মপরিবেশের উন্নতি হয়েছে বলে তারা জানাচ্ছেন। ফলে এসব বিষয়ও তদন্তে বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই তদন্ত কমিটিকে শুনানি-পূর্ব প্রতিবেদন দিয়েছে পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ।

মার্কিন শুনানিতে অংশ নেয়ার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতাবিরোধী কোনো কাজ তো করছেই না বরং বাজারটিতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতায় পড়েছে। বিশেষ করে উৎপাদন খরচ পাকিস্তান ও চীনের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। সেইসঙ্গে গত ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা সেই অনুযায়ী পোশাকের মূল্য বাড়াচ্ছেন না। তিনি বলেন, এসব বিষয় তুলে ধরে ইতিমধ্যে মার্কিন কমিশনকে চিঠি দিয়েছি। আগামী ১১ই মার্চ ভার্চ্যুয়ালি এ শুনানিতে অংশগ্রহণ করবো।

ফারুক হাসান বলেন, আমরা মনে করি না এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে। কারণ কোনো কালেই যুক্তরাষ্ট্রে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই না। এখনো নাই, আগামীতেও পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। তাই কোনো প্রভাব পড়বে না। তারপরও তাদের সঙ্গে কথা বললে আমরা এই তদন্তের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবো। আমরাও জানতে চাই। কারণ তারা ডিটেইলস কিছু বলেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত শুরুর বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধম্যকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে। এটিকে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ শুধু বাংলাদেশ নয়, মার্কিন বাজারে পোশাক রপ্তানিকারক শীর্ষ দেশগুলোতে এই তদন্ত শুরু করেছে ওয়াশিংটন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছি, তদন্ত যদি বস্তুনিষ্ঠ হয়, তবে সেটি তারা করতেই পারে। কিন্তু এতে যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকে। ঢাকা এটাই প্রত্যাশা করে। শুনানির প্রস্তুতি রয়েছে এবং ওয়াশিংটনে তা তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম বলেন, বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলার জন্য এ তদন্ত হতে পারে। যদি বেশি চাপিয়ে দেয়া হয় তবে অন্যায় হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই তদন্ত কমিটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির পাশাপাশি সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে কাঠামোগত পাথর্ক্যগুলোর সামগ্রিক মূল্যায়ন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ।

এই তদন্তে মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রম পরিবেশ, শ্রমিক কল্যাণ, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানান তিনি। যদিও এসব বিষয়ে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি রয়েছে বলে মনে করেন মি. আজিম।

গার্মেন্ট শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ সরকার যাতে শ্রমিকদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে তদন্তে ব্যবহার না করে, সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনে শুনানি-পূর্ব যে প্রতিবেদন বিজিএমইএ দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ, গ্যাসের দাম ২৮৬.৫ শতাংশ, ডিজেলের দাম ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পণ্য পরিবহনে এর প্রভাব পড়েছে।

গত ১লা মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ২০২৪ সালের বাণিজ্য নীতি এজেন্ডা ও ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ইউএসটিআর ওয়েবসাইটে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে ইউএসটিআর বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা ২০১৩ সালে প্রত্যাহারের পর শ্রমিকদের সুরক্ষার মান ও অধিকার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের এই একটা বিষয়েই ঘাটতি রয়েছে, প্রত্যেকটা ফ্যাক্টরিতে ট্রেড ইউনিয়ন করা। যুক্তরাষ্ট্র এটা ম্যানডেটরি করতে চায়। এটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের ‘অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলস’ (অটেক্সা) হিসাবে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক গেছে ৯.৭২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের, যা এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। তবে এটা ঠিক কোভিড-১৯ পরবর্তী ২০২১ সালে রপ্তানি কম ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে ৯.৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হলেও ২০২৩ সালে সেটা না বেড়ে বরং কমেছে।

২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছে ৭.২৯ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং এক বছরে রপ্তানি কমেছে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার বা ২৫ শতাংশ।

https://mzamin.com/news.php?news=100764