৮ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৭:০৮

আইএমএফের ফর্মুলায় পৌনে দুই ভাগ কমলো জ্বালানি তেলের দাম

দেড় বছর আগে বাড়ানো হয়েছিল ৪২ শতাংশ

আইএমএফের ফর্মুলা অনুসারে সরকার জ্বালানি তেলের দাম গড়ে পৌনে দুই শতাংশ কমিয়েছে। তবে এর মধ্যে ডিজেলের দাম কমানো হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। এর দেড় বছর আগে (আগস্ট-’২২) জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২৩ দিনের মাথায় প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়েছিল। তার পরেও দাম বেড়েছিল গড়ে ৪০.৪২ শতাংশ। এরপর প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে যায়, যা আজো অবধি অব্যাহত রয়েছে। দেড় বছর পর আন্তর্জাতিক বাজারে সাথে জ্বালানি তেলের সমন্বয়ের কথা বলে গড়ে কমানো হয়েছে ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এর মধ্যে অকটেনের দাম কমছে ৪ টাকা, পেট্রলের ৩ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিনে কমানো হয়েছে ৭৫ পয়সা। এতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা। অকটেনের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২৬ টাকা। আর পেট্রলের দাম ১২৫ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২২ টাকা। গতকাল জ্বালানি তেলের নতুন এ দাম নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। নতুন এ দর আজ শুক্রবার থেকেই কার্যকর হবে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ২০২২ সালের আগস্টে সবধরনের জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। পরে প্রতি লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। ৫ টাকা লিটারে কমানোর পরেও প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম হয় ১০৯ টাকা। ওই সময় প্রতি লিটারে বেড়েছিল ৩৬.২৫ শতাংশ। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় প্রতি লিটারে কমানো হলো ৭৫ পয়সা। দাম কমানোর হার শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ। প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৫ টাকা কমানোর পরও আগের তুলনায় ৪১ টাকা বেড়ে হয় ১৩০ টাকা। দাম বৃদ্ধির হার ছিল ৪৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় প্রতি লিটারে ৪ টাকা বা ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ কমানো হলো। দেড় বছর আগে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এর সাথে ৪৫.৩৫ শতাংশ লিটার করা হয় ১২৫ টাকা। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় কমানো হলো লিটারে ৩ টাকা বা ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ : বাংলাদেশের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের জন্য স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের সূত্রটি আইএমএফের অন্যতম শর্ত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তাবলী মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযুক্ত একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে।

বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে। সরকার প্রাথমিকভাবে চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল। তবে জাতীয় নির্বাচন এবং অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে এটি স্থগিত করা হয়েছিল। পরে মার্চ থেকে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় পরিশোধের দিন বিনিময় হারের ভিত্তিতে গণনা করা হবে। অতিরিক্তভাবে, চূড়ান্ত মূল্যের মধ্যে শুল্ক কর, ডিলার কমিশন, সম্ভাব্য বিপিসির উন্নয়ন খরচ, পরিচালন ব্যয়, পরিবহন চার্জ এবং অল্প লাভের মার্জিন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এসব বিষয়ের ভিত্তিতে প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হবে।

জানা গেছে, সূত্রটি তৈরি করা হয়েছে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি সমতা মূল্যের ওপর ভিত্তি করে। এর মানে হলো যে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি তেলের দাম পরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এই বিবেচনা করে যে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানির ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যে পরিশোধিত হয়েছে।

সীমান্তের ওপারে জ্বালানি তেলের চোরাচালান ঠেকাতে ভারতের জ্বালানি তেলের দামও সূত্রের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামকে ভারতের বাজারমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য করে, সরকার প্রণোদনার বিষয়ে নজর রাখে। এ ছাড়া ভোক্তা জ্বালানির দামে অতিরিক্ত লাভের মার্জিন বেসরকারি খাতের শোধনাগার প্রতিষ্ঠা এবং জ্বালানি তেল বিপণনের জন্য সরকারের পরিকল্পনাকেও প্রতিফলিত করে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য জ্বালানি তেলের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা এবং অবশেষে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্য প্রস্তাব করা।

একবার বেসরকারি খাতে শোধনাগার ও জ্বালানি তেল বিপণন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলে, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই একই দামে জ্বালানি তেল বিক্রি করা হবে। এই একীভূত মূল্য নির্ধারণ করা হবে প্রাইসিং প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর জন্য লাভের মার্জিন অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে সরকার আরো দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক জ্বালানি বাজার থেকে উপকৃত হবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

হতাশ গ্রাহকরা : জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পর সামান্য কমায় হতাশ হয়েছেন সাধারণ গ্রাহক। সামান্য কমানোর পর আবার বাড়ানো হয় কি না তা নিয়েও তারা আশঙ্কা করছেন। কারণ এখন থেকে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হবে। আবার কমলে স্থানীয় বাজারে কমানো হবে। কিন্তু দেড় বছর আগে যে ব্যাপকভিত্তিতে দাম বাড়ানো হয়েছিল সমন্বয়ের সময় তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেশি কমানো প্রয়োজন ছিল। কারণ সেচ মৌসুমে কৃষকদের বেশি উপকার হতো। কিন্তু লিটারে ৭৫ পয়সা কমানোয় তেমন কোনো উপকার হবে না বলে তারা জানিয়েছেন।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র নির্ধারণ করে এক নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশে ব্যবহৃত অকটেন ও পেট্রল ব্যক্তিগত যানবাহনে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বিলাসদ্রব্য (লাক্সারি আইটেম) হিসেবে সব সময় ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রলের দাম বেশি রাখা হয়।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কৃষক ও গণপরিবহনে ব্যবহৃত হয় ডিজেল ও কেরোসিন। অথচ এ দু’টি পণ্যে কমানো হয়েছে লিটারে ৭৫ পয়সা। যেখানে বাড়ানো হয়েছিল ২৯ টাকা, সেখানো কমানো হয়েছে মাত্র ৭৫ পয়সা। এই সামান্য কমানোয় কৃষকের তেমন কোনো উপকার হবে না, কমবে না গণপরিবহনের ভাড়া। তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে জ্বালানি খাতে ভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষা হচ্ছে না; বরং প্রতি পদে পদে ভোক্তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।

জ্বালানি বিশ্লেষকদের মতে, বছরের পর বছর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। উৎপাদন ক্ষমতা করা হয়েছে মোট চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে জনগণের পকেট থেকে অর্থ নেয়া হচ্ছে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানির উৎস সমৃদ্ধ করতে তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর ফলে উচ্চ মূল্যের এলপিজি কিনেছে। যার মাসুল এখন জাতিকে দিতে হচ্ছে। কুইক রেন্টালের মতো প্রকল্প বন্ধ ও অদক্ষতা দূর না করলে জনগণকে আরো বেশি বিপদে গড়তে হবে বলেও তারা জানান।

এ দিকে জ্বালানি তেল থেকে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের কর আদায় করে থাকে সরকার। মোটা দাগে সরকারের ভ্যাট ট্যাক্স পরিশোধের পরিসংখ্যান দিয়ে বিপিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সব শ্রেণীর জ্বালানি তেলে আমদানি শুল্ক রয়েছে রয়েছে ১০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ও আয়কর মিলে পরিশোধ করতে হয় আরো ৫ শতাংশ। অন্যান্য কর মিলে সব শ্রেণীর জ্বালানি তেলে সরকারের ভ্যাট ট্যাক্স হিসেবে পরিশোধ করতে হয় প্রায় ৩৪ শতাংশের ওপরে। এর সাথে গ্রাহকপর্যায়ে সরবরাহকৃত মূসক ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক আদায় করতে হয় ২ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার মতে, জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্স একটু কমিয়ে দিলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম আরো কমানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। বিপিসির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশ জোগান আসছে স্থানীয় উৎস হতে এবং অবশিষ্ট প্রায় ৯২ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে। প্রতি বছরেই জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। বিপিসির প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯৭৬ সালে দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা ছিল প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন। ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে গত (২০২১-২২) অর্থবছরে চাহিদা ছিল প্রায় ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে ব্যবহৃত মোট জ্বালানি তেলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫ লাখ টন। ব্যবহৃত জ্বালানির ৭৩.১১ শতাংশ ডিজেল, ৬.৬২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ৫.৮৬ শতাংশ পেট্রল, ৪.৭৮ শতাংশ অকটেন, ১.৯২ শতাংশ কেরোসিন, ৬.২৭ শতাংশ জেট এ-১ এবং ১.৪৪ শতাংশ অন্যান্য তেল। আর জ্বালানি তেলের ৬৪.২৭ শতাংশ পরিবহন, ১৮ শতাংশ কৃষি, ৭.৬৫ শতাংশ শিল্প, ৬.৭৪ শতাংশ বিদ্যুৎ, ১.৯৭ শতাংশ গৃহস্থালি এবং ১.৩৭ শতাংশ অন্যান্য খাতে ব্যবহার হয়েছে। আর ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় ৮৪ শতাংশ নৌপথে, ৯ শতাংশ রেল পথে এবং ৭ শতাংশ সড়ক পথে পরিবহন হয়ে থাকে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/819742